শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আর এক দধীচি

আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৩:০৩

আজকে পৃথিবীর মানচিত্রে যে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ, তার বাস্তবতাকে সফল করতে কত মানুষেরই যে আত্মত্যাগ দরকার হয়েছিল! তাঁদের মধ্যে অনেকেই অজানা অচেনা অবজ্ঞাত। ইতিহাস তাঁদের পাদপ্রদীপের সামনে নিয়ে আসতে পারেনি। টমাস গ্রে তাঁর Elegy Written in a Country Churchyard কবিতায় সেইসব ভাগ্যহীনদের জন্য পরিতাপ মেশানো দীর্ঘশ্বাস নিয়ে লিখে গেছেন —Full many a flower is born to blush unseen/And waste its sweetness on the desert air.

কেউ কেউ আবার অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন সমগ্র জীবন দেশজননীর জন্য বলিপ্রদত্ত হয়ে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁদেরই অন্যতম। সাগ্নিক যোদ্ধা, যদিও দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। পরাধীন ভারতবর্ষের কুমিল্লায় তাঁর জন্ম। ভারত-ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে ১৮৮৬-তে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূচনালগ্নে, ১৮৮৫-র ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জন্মলাভ করার ঠিক পরের বছর। পড়াশোনা স্থানীয় স্কুল ও পরে কলকাতার রিপন কলেজে। প্রথমে শিক্ষকতা, পরে ওকালতি ব্যবসায়ে নিযুক্ত থাকার পাশাপাশি রাজনীতিতে যোগ দেন ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে। দেশ যখন উত্তাল। প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথের রাজনৈতিক নেতা। আমরা জানি, বঙ্গভঙ্গকে লর্ড কার্জন বলেছিলেন Settled fact, আর সুরেন্দ্রনাথ তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, I will unsettle it, এবং তা হয়েছিল। বিশিষ্ট ব্যারিস্টার ও কুমিল্লা জেলার অপর এক স্বনামখ্যাত মানুষ আবদুর রসুলও ছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে ধীরেন্দ্রনাথের পথপ্রদর্শক। ধীরেন্দ্রনাথের এ-সময়কার রাজনীতি ছিল পরাধীন ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে, এবং এর পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজ। ১৯১৯-এ কংগ্রেসের ময়মনসিংহ প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দেওয়া থেকে ১৯৩৭-এ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হওয়া, ১৯৪২-এ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশগ্রহণ, ১৯৪৬-এ কংগ্রেসের হয়ে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া ছিল এই সময়কার, অর্থাত্        প্রাক-১৯৪৭ সময়ের কার্যাবলি ও দায়িত্বপালন।

এরপর এলো পাকিস্তানপর্ব। এ সময়ে তাঁর গৌরবময় ও ঐতিহাসিক ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সদ্যোজাত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে যখন প্রশ্ন দেখা দেয় পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার ছ’মাসের মাথায়, ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে ধীরেন্দ্রনাথ পাকিস্তান গণপরিষদে একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। বাংলাভাষার প্রতি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টি ফেরানো যেমন এর উদ্দেশ্য ছিল, তেমনি ভাষা-আন্দোলনের বীজও উপ্ত হয়েছিল এর মাধ্যমে।

মূল প্রস্তাবে ছিল, ইংরেজি ও উর্দু পাকিস্তান গণপরিষদের (পাকিস্তান রাষ্ট্রের নয়, মনে রাখা জরুরি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে, এ ঘোষণা দেন জিন্নাহ ১৯৪৮-এর একুশে মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। হয়তো সেটা ছিল ধীরেন্দ্রনাথের ভাষণেরই প্রতিক্রিয়া।)

ধীরেন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের গোড়াপত্তন যে ভাষা আন্দোলন, তার গোড়ায় ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। যে-রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, তার সূচনায় তাঁর আত্মাহুতি। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নামটি তাই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।’

ধীরেন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম বাংলাভাষার সপক্ষে সরব হন, যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে, পরিণত হয় বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে কম মূল্য দিতে হয়নি। বারবার জেলে যেতে হয়েছে। ১৯৬০-এ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে এবডো-র কড়া চাবুক (Elective Bodies Disquqlification Order), যার ফলে তাঁকে রাজনীতি করার অধিকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখে পাকিস্তান সরকার। এর আগে অবশ্য ১৯৫৬ থেকে ৫৮-তে আতাউর রহমানের মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী। পরাধীন ভারতেও ১৯৪৬-এর বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচিত সদস্য হয়েছিলেন। কংগ্রেসের হয়ে সেবার নির্বাচনে নামেন।

ঊনত্রিশে মার্চ উনিশ শ একাত্তর। মাত্র দিন তিনেক আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, আর ছাব্বিশ তারিখ অপারেশন সার্চলাইটের নামে শুরু হয়েছে পাকবাহিনীর নির্মম গণহত্যা। প্রথম রাতেই পাকবাহিনী ঢাকা শহরকে নরক বানিয়ে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপকসহ ছাত্রছাত্রীর নির্মম মৃত্যু ঘটে। সারা দেশে পাকিস্তানি জুন্টা আক্রমণ চালায় সাধারণ মানুষের ওপর।

ঊনত্রিশে মার্চ কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার হন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেনানিবাস, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় স্থাপিত ও বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুরুত্বপ্রাপ্ত ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে এবং তাঁর কনিষ্ঠপুত্র দিলীপকুমার দত্তকে। নিদারুণ নির্যাতন করে পিতা-পুত্রকে কেবল যে হত্যা করা হয়েছিল তা-ই নয়, তাঁদের মৃতদেহ পর্যন্ত গায়েব করে ফেলা হয়। পৌরাণিক ঋষি দধীচি জীবনোত্সর্গ করেছিলেন অপশক্তিকে পরাজিত করতে। দধীচির হাড় দিয়ে তৈরি হয়েছিল বজ্র। ধীরেন্দ্রনাথও যেন আর এক দধীচি।

স্বাধীনতার পরে তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়। কুমিল্লার স্টেডিয়ামটি তাঁর নামে নামাঙ্কিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-লাইব্রেরিটিও তাঁর নামে। এছাড়া কুমিল্লা পৌরসভা তাঁর নামে একটি রাস্তার নামকরণ করেছে। বাংলা একাডেমির জীবনী গ্রন্থমালায় তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বিশদ লিখেছেন কবি মিনার মনসুর।

শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি তাঁকে।

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন