শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

লাল ফুল আর পলেস্তারা-খসা বাড়ির গল্প

আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৩:০৬

‘আ মার কী ইচ্ছে করে, জানেন?’ শামীম ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে আমি বললাম, ‘এফসিপিএস পাশ করতে চান।’

হা-হা করে অট্টহাস্য দিয়ে শামীম ভাই ট্রেনের জানালা দিয়ে দৌলতকান্দি মহিউদ্দিন ভুঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয় দেখিয়ে বললেন, ‘যদি সুযোগ পেতাম, এই স্কুলে পড়ার জন্য ভর্তি হতাম।’

শামীম ভাই আমার কলিগ; শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক হবার জন্য পড়াশোনা করছেন। ভাবি চাকরিসূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পোস্টেড। এ কারণে শামীম ভাই মাঝে মাঝে ট্রেনে আমার সঙ্গী হন। নরসিংদীর রায়পুরার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই সুন্দর। দৌলতকান্দি এম বি স্কুলটি নদীর পাড়ে গাছপালা ঘেরা মাঠের ঐ পাশে। নদীটাকে মরা নদী বলে। আসলে এটা মেঘনাকে সাপমারায় ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে যুক্ত করেছে। আমরা ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার সময় এই স্কুলের পরিবেশ দেখি আর হা-হুতাশ করি, কেন এরকম একটি সুন্দর স্কুলে পড়তে পারলাম না! এই স্কুলের ছাত্ররা না জানি কত সুখী!

সুযোগ পেলেই রায়পুরার বিভিন্ন এলাকায় বিকেলে আমি হাঁটতে বের হই। যখন পা আর চলে না তখন রিকশা নিয়ে ডরমেটরিতে ফিরে আসি। মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে শ্রীরামপুর রেলগেট পার হয়ে রায়পুরা বাজারে চলে আসি। একটু নাস্তা করে পুব বরাবর আর একটু হাঁটলেই মেঘনা নদীর একটা শাখায় পৌঁছে যাই। গুদারাঘাটে দাঁড়িয়ে মনে মনে পরিকল্পনা করি—কোনো একদিন নদী পাড় নবীনগরের বাইশ মৌজা লালপুর গ্রামে পৌঁছে যাব। লালপুর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি জালশুকা তিন-চার মাইল।

ইপিআই-এর টিকা কর্মসূচিতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ইউনিয়নে কার্যক্রম ঠিকমতো হচ্ছে কি না পরিদর্শনে যাই। নৌকা, ট্রলার, ট্রেন, রিকশা—যখন যেটা দরকার সেই বাহনে চেপে দূরবর্তী ইউনিয়নগুলোতে। চব্বিশটা ইউনিয়ন নিয়ে নরসিংদীর বিশাল রায়পুরা উপজেলায় ছয়টি রেলস্টেশন। বিশাল গাছ আর বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাড়িগুলো দেখে অবাক হতে হয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজের পাহাড়।

দৌলতকান্দি স্টেশন পার হতেই একটি পিচের রাস্তা ডান দিকে ভৈরব বরাবর চলে গেছে। শামীম ভাইকে ঐ রাস্তা দেখিয়ে বলি, ‘একদিন এই রাস্তা ধরে আমি ভৈরবের পাশে মেঘনার পাড়ে চলে গিয়েছিলাম।’

প্রায়ই হরতাল হতো তখন। হরতালের সময় মাঝেমাঝে নরসিংদী বা টঙ্গীতে ট্রেন কোনো কারণে আটকা পড়লে বিকল্প পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতাম। আলী হোসেন মিয়ার সঙ্গে কথা বলায় রায়পুরা বাজার থেকে বামদিকে মৌলভীবাজার-সাপমারা রোডের কথা জানতে পারি। এক হরতালের দিনে বিসমিল্লাহ বলে রিকশা নিয়ে এই রাস্তা বরাবর এগোতে থাকি। রিকশাওয়ালা বেশ কথক। এই এলাকা সম্বন্ধে জানতে চাইলে উনি বাংলাদেশ বেতারের ফুটবল ধারাভাষ্যকার খোদাবক্স মৃধার মতো একটানা এলাকা সম্বন্ধে ধারা বিবরণী দিয়ে যাচ্ছেন—ঐ যে টিনের বড় বাড়িটা দেখতাছেন এইটা হইলো আগের এমপি সাবের বাড়ি। সামনে মহিষমারা গ্রাম, তার বাদে সাপমারা গ্রাম।’

আমি হেসে বলি, ‘আপনাদের এখানে খালি মারামারির ব্যাপার-স্যাপার। গ্রামের নামেও দেখি মারামারি ঢুকে পড়েছে।’ মাঝপথে বেশ কয়টি খালের উপর দিয়ে উঁচু পুল পার হতে রিকশা থেকে নামতে হলো। একটি প্রাচীন মসজিদ দেখিয়ে উনি বললেন, ‘বুঝলেন ভাই, এই মজ্জিদে আমি একদিন নামাজ পড়ছিলাম।’ উনার উচ্ছ্বাস দেখে আমিও মনে মনে হাসি। এই রাস্তার শেষ মাথায় এসে আমাকে সামনের দিকে বেঁকে যাওয়া রাস্তাটি দেখিয়ে বললেন, ‘হেইদিকে আরেট্টু দূর আগাইলে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের বাড়ি। জায়গাটা সাপমারার মতিউরনগর।’

হঠাত্ করে ফাঁকা রাস্তার দিকে সামনে তাকাতেই দেখি দৌলতকান্দি রেলস্টেশন। এখান থেকে ডানদিকে অসংখ্য বিশালকায় শিমুল ফুলের গাছের নিচ দিয়ে যাবার সময় মনে হলো, এত সুন্দর পথে তো আগে কখনোই আসিনি। সড়কের চারপাশে ধানখেত, আকাশের নীলচে কালো ক্যানভাসের মাঝে শিমুল-মান্দার গাছের লাল ফুল এক অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে। সাপমারা-গৌরীপুর রোড ধরে কোহিনুর জুট মিলকে পাশে রেখে মেঘনার গৌরীপুর মিল বাজার ঘাটে পৌঁছে যাই। নৌকায় মেঘনা পাড়ি দিয়ে আশুগঞ্জে আসি।

গতদিন আলী হোসেন মিয়া রায়পুরা বাজার থেকে তুলাতুলী আসার পথে পিটিআই রায়পুরার আশেপাশের প্রাচীন অনেকগুলো বাড়ি দেখিয়ে বলেন, ‘এহনো লোকজন এই বাড়িতে থাকে।’ বিরাট স্তম্ভের মতো বাড়িগুলোর পলেস্তারা খসে গেছে। কালের আবর্তনে কৌণিক ইটগুলো অনেকটা গোলচে শেপের হয়ে গেছে। দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে। প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ির চারপাশে বিরাটকায় প্রাচীন গাছ। সন্ধ্যায় ফিলিপসের হালকা হলদে বিষণ্ন আলোর বাল্বগুলো মন খারাপ করা চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়—জীবন ক্ষণস্থায়ী—এই বাড়িগুলোর প্রতিষ্ঠাতা একদিন ছিল, এখন আর নাই। শ্যাওলাধরা পলেস্তারা খসা বাড়িগুলো যেন বলে দেয়—বিত্ত-বৈভব আর আয়ু—সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় মহাকাল। পড়ে থাকে শুধু ধূসর বিবর্ণ সব স্মারক।

[লেখক: চিকিত্সক, শিক্ষক]

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন