শুক্রবার, ০৯ জুন ২০২৩, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

দুটি গ্রন্থে বাংলাদেশের রাজনীতির অতীত রোমন্থন

আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৩:১৮

ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলায়। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক যেসব কারণে এখান থেকে অসংখ্য মানুষ ওপার বাংলায় পাড়ি দিয়েছেন, সুখরঞ্জন দাশগুপ্তকেও একই কারণে জন্মভূমি ছেড়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি তিনি হূদয়ের টান অনুভব করেন এখনো। পেশাগত জীবনে তিনি বহুবছর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের দুটি সংকটময় সময়ে—১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালে, তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঐ সময় তাঁর দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ নিয়ে রিপোর্ট কভার করা। স্বাভাবিক কারণেই তিনি বাংলাদেশের সেই ঘটনাবহুল সময়ের একজন জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আছেন। সেই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যত শীর্ষপর্যায়ের মানুষ ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবার সঙ্গে সুখরঞ্জনের ছিল ব্যক্তিগত যোগাযোগ। পেশাগত দায়িত্ব ছাপিয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বলয় প্রশস্ত হয়েছিল। এখনো তাঁদের মধ্যে যাঁরা জীবিত আছেন, যাঁরা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা সুখরঞ্জন দাশগুপ্তকে এক নামে চেনেন, জানেন। তাঁদের স্মৃতিতে সুখরঞ্জনের রিপোর্ট ভেসে ওঠে। তার সেসব রিপোর্টের কথা এবং সেই সময়ে পর্দার আড়ালে বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া সুখরঞ্জন নিজেও ভোলেননি।

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্প্রতি তাঁর স্মৃতি, তাঁর দেখা নিয়ে দুটো গ্রন্থ রচনা করেছেন। ২০২২ সালে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকেই প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী’ নামের দুটো গ্রন্থ। স্মৃতিচারণমূলক রচনাধর্মী দুটো বইই প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রকাশক জিনিয়াস। এই গ্রন্থ দুটিতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা। উঠে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বাপর অনেক নেপথ্য কাহিনি। মানুষ তো আসলে নেপথ্য ঘটনাবলিই জানতে চায়। সেদিক দিয়ে সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের গ্রন্থদুটি মূল্যবান পাঠ হতে পারে ইতিহাস ও রাজনীতি-সচেতন মানুষদের জন্য। রিপোর্টার হিসাবে তিনি মাঠপর্যায়ে অনেক স্থানে ঘুরেছেন। অনেক খণ্ডযুদ্ধের বর্ণনা করেছেন। আনন্দবাজারের মতো খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকার রিপোর্টার হিসাবে তাঁর প্রবেশাধিকার ছিল অনেক প্রশস্ত। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা সরকারের বিভিন্ন ভূমিকা। মনোযোগ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালে খোন্দকার মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুররা কীভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন, কীভাবে ভারতীয় গোয়েন্দা এবং প্রশাসন তাঁদের প্রতিরোধ করেন—সেসব কাহিনিও পুঙ্খানুপু্ঙ্খ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন তিনি। তাঁর রচনার ধরন একটু তুলে ধরা যাক: তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘আমার মনে আছে এমনই একদিন সকাল থেকে যুদ্ধসংক্রান্ত খবরের সূত্রগুলো বারবার ফোন করা সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করছিল না। অফিসে বসেছিলাম। হঠাত্ বিএসএফের জয়েন্ট ডিরেক্টর শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় খুব আস্তে আস্তে আমাকে বললেন, ‘খবর যদি চাও তবে একজন ফটোগ্রাফার নিয়ে ৫টার মধ্যে বিমানবন্দরে চলে এসো।’ বিমানবন্দর প্রচুর পুলিশ ঘেরা। কী হচ্ছে আমি বুঝতে পারিনি। শরদিন্দু আমাকে ইশারায় কাউন্টারের দিকে যেতে বললেন। সেখানে গিয়ে দেখি মাহবুবুল আলম চাষী কাউন্টারে টিকিট জমা দিয়ে নিউ ইয়র্কের বোর্ডিং পাস নিতে প্রস্তুত হয়েছেন। তখনই ভারতীয় গোয়েন্দারা ঝাঁপিয়ে পড়ে টিকিটগুলো কেড়ে নিলেন, আর বললেন, ‘আপনারা এতবড় দেশদ্রোহী! চলুন, পুলিশের গাড়িতে উঠুন!’ তাঁদের আর নিউইয়র্ক যাওয়া হলো না (বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী)।’

এসব ইতিহাস কিন্তু স্মৃতিচারণ থেকেই পাওয়া যায়, সাধারণ ইতিহাস থেকে নয়। সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত এসব নিয়ে আরো গ্রন্থ লিখেছেন, যেগুলো ভারত থেকে প্রকাশিত। কিন্তু এই গ্রন্থদুটি একান্তই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং সেই সময়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। বাক্য গঠনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে। সেটা অসাবধানতাবশত এবং আমাদের চিরাচরিত এডিটিং-এর দুর্বলতার কারণে। কিন্তু অনেক তথ্যই পাঠকদের অনেক অজানা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেবে বলেই আমার বিশ্বাস।

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন