অন্যান্য সময়ের চেয়ে রোজায় চিনির চাহিদা থাকে বেশি। তাই রোজা সামনে রেখে সরকার চিনি আমদানিতে শুল্কছাড় দিয়েছিল। শুল্ক কমানোর পর সরকারি হিসাবে চিনির দাম আরও ২ শতাংশ বেড়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দাম অর্থাৎ ১০২ টাকা কেজি দরে মিলগেট থেকে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। সরবরাহেও সংকট রয়েছে। যদিও চিনিকল মালিকদের দাবি, চিনির পর্যাপ্ত মজুত আছে। সরবরাহে কোনো সংকট নেই। এমন অবস্থায় ভোক্তাদের অভিযোগ চিনি নিয়ে ছিনিমিনি করে সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ শুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন ২৬ জানুয়ারি চিনির দাম ঠিক করে বাণিজ্য সচিবের কাছে চিঠি দেয়। তাতে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম চার টাকা বাড়িয়ে ১১২ টাকা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়। তবে সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে সব দোকানেই চিনির পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকাতে, প্যাকেটজাত সাদা চিনিও ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে দেশি লাল চিনি দোকানিরা বিক্রি করছেন না। কোথাও কোথাও তা পাওয়া গেলে লাল চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায়।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকার চিনির দর বেঁধে দেয়।আমদানিকারকরা শুল্ক কমানোর অনুরোধ জানান সরকারকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপেক্ষিতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, রমজান মাস সামনে রেখে চিনির বাজারে অস্থিরতা কমাতে চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছে এনবিআর। এই সুবিধা আগামী ৩০ মে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এ ছাড়া প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে তিন হাজার টাকা ও পরিশোধিত চিনি আমদানিতে ছয় হাজার টাকা আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে খুচরা বাজারে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৪৬ শতাংশ। খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, পাইকারি বাজারে দাম বেশি। পাইকারিতে না কমলে খুচরা বাজারে দাম কমার কোনো সুযোগ নেই। চিনির দাম না কমার জন্য পাইকারি ব্যবসায়ীরা দায়ী করলেন আমদানিকারক বা মিলারদের।
বাড্ডা বাজারের বিসমিল্লাহ স্টোরের দোকানি আরমান মিয়া বলেন, শুল্ক কমানোর কোনো খবরই বলেনি কোম্পানিগুলো। চিনির দাম কমেনি, উল্টো বাড়ছে। প্রতি বস্তায় পাইকারিতে আরও ২০ টাকা বেশি দিয়ে চিনি কিনেছি। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে ৫০ টাকার মতো দাম বেড়েছে।
যাত্রাবাড়ির দোকানি হামিদ বলেন, চিনির সংকট কিছুটা কেটে গেছে। প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ কম। খোলা চিনি আছে। দাম আগের মতোই। তবে দাম বাড়ানোর কয়েক দিন আগে কোম্পানির ডিলাররা কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে যান আমাদের। আপাতত দাম কমার কোনো লক্ষণও দেখি না।
নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জের বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, চিনির বাজারে অস্থিরতার মূলে রয়েছে মিল থেকে চাহিদা অনুযায়ী চিনি সরবরাহ না করা। ডিও কেটে এক-দেড় মাস চিনির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ডিওতে যে পণ্য সরবরাহের তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, সে তারিখে চিনি পাওয়া যায় না। চিনি পেতে হলে আরো ছয়-সাতদিন মিলগেটে ট্রাক নিয়ে বসে থাকতে হয়। ফলে সব খরচ মিলিয়ে পাইকারি বাজারে আমাদের ১০৫-১০৬ টাকা কেজিতে চিনি বিক্রি করতে হচ্ছে।
মিলাররা বলছেন, বেশি শুল্কের আওতায় আমদানি করা চিনি কম দামে বিক্রি করার সুযোগ নেই। চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজেআই) সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক মুজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আগের আমদানি করা চিনি শুল্ক ছাড়ের আগেই খালাস করা হয়েছে। সেগুলোতে বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হয়েছে। কোম্পানিগুলোর গুদামে থাকা সেই চিনি বর্তমান দরেই বিক্রি করতে হচ্ছে। শুল্ক ছাড়ের ঘোষণার পর থেকে যে চিনিগুলো বন্দর থেকে খালাস করা হবে, সেগুলোতে নতুন দাম নির্ধারণ হতে পারে।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য বলছে, প্রতি মাসে দেশে চিনির চাহিদা ১ লাখ ৫৮ হাজার টন। বছরে ১৯ লাখ। রমজান এলেই চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ টনে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, আব্দুল মোনেম এবং দেশবন্ধু সুগার লিমিটেডের কাছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৬৩ দশমিক ৬৮ টন চিনি মজুদ আছে। এর বাইরে পাইপলাইনে আছে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৫০ টন চিনি।
রজমানের আগে গত ১৯ মার্চ সচিবালয়ে ‘দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা–সংক্রান্ত টাস্কফোর্স এর ষষ্ঠ সভা’ শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চিনি ও তেলের দাম নিয়ে আমরা চিন্তিত। দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভায় ব্যবসায়ীরা শিগগিরই দাম কমানোর আশ্বাসও দিয়েছেন। তারা তাদের আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রাখতে চান। অন্যথায় হার্ডলাইনে যাবে সরকার।
এদিকে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিডিপি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, কিছু কিছু পণ্যর দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়েও বেশি। বিশেষ করে দেশের বাজারে চাল, সয়াবিন তেল, চিনি ও মাংসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দর কমলেও দেশের ‘দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে’ তার কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।’