গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সুমি আক্তার। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সুমির বিয়ে হয়। বছরখানেক পরেই সুমি জন্ম দেয় এক কন্যা সন্তান। কিন্তু শিশুটির ঘাড় বাঁকা। শিশুটি সব সময় শুয়ে ও মায়ের কোলে থাকে। মাথা সোজা করে রাখতে পারে না। চিকিত্সক জানিয়েছেন, জন্মগত ত্রুটির কারণে শিশুটির এ অবস্থা হয়েছে। দরিদ্র পরিবারটির পক্ষে সম্ভব হয়নি শিশুটির সঠিক চিকিত্সা দেওয়ার। এ অবস্থায় ১৯ মাস বয়সে শিশুটি মারা যায়।
এমন জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে ৭ শতাংশ শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি বাংলাদেশে কত সংখ্যক শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে, তা দেখতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। দেশের ২০টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে জরিপটি চালানো হয়। ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আট বছর ধরে চিকিত্সা নিতে আসা ১১ হাজার ২৩২ জনের ওপর এ জরিপে দেখা যায়, এসব চিকিত্সাসেবা কেন্দ্রে নানা শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ শিশু। তিন পদ্ধতিতে এসব ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে। খালি চোখে, যন্ত্রপাতি দিয়ে এবং নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে। তবে এ জরিপে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে জন্ম নেওয়া ৪০ শতাংশ শিশু ও কমিউনিটি পর্যায়ে জন্ম নেওয়া শিশুর তথ্য আসেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতাল কিংবা মাতৃ সদনের বাইরে সন্তান প্রসবসহ নানা কারণে দেশে বাড়ছে জন্মগত ত্রুটিযুক্ত শিশুর সংখ্যা। এর মধ্যে জলবায়ু ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ, তেজস্ক্রিয়তা, গর্ভাবস্তায় অসংক্রামক রোগ— উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এছাড়া বাল্যবিয়ে বা দেরিতে বিয়ে, অপুষ্টিতে ভোগা, অসচেতনতা, গর্ভকালে চিকিত্সকের পরামর্শ না নেওয়া, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে অন্যতম। তারা বলছেন, জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুর সমস্যা দ্রুত শনাক্ত ও যথাযথ চিকিত্সা নিলে এসব শিশুর দুই-তৃতীয়াংশই সুস্থ জীবনে ফিরতে পারে। তবে অনেক শিশুর একাধিক সমস্যা থাকায় চিকিত্সা শেষ না করেই হাসপাতাল ছাড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নবজাতকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটিকে ৪ নম্বর সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বে প্রতি ১০০ নবজাতকের মধ্যে অন্তত ৬ শতাংশ শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। বছরে লাখ লাখ শিশু মারা যায় এ কারণে। তবে বাংলাদেশে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে কত শিশু জন্মায়, তার সঠিক কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। সবচেয়ে কম জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্মায় জাপানে, ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ৫০ শতাংশ জন্মগত ত্রুটির কোনো ব্যাখ্যা নেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জন্মগত ত্রুটির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর শুধু জন্মগত ত্রুটির জন্য এ অঞ্চলে জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ শিশু মারা যায়। শিশু মৃত্যুর এই প্রভাব টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
বিএসএমএমইউর জরিপের সঙ্গে যুক্ত একাধিক চিকিত্সক জানান, সঠিক পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের প্রতিটি হাসপাতালে এমন ত্রুটিযুক্ত নবজাতক শনাক্তের হার অনেক গুণ বাড়বে। কিছু জন্মগত ত্রুটি, যেমন কানের ফুটো না থাকা, ঠোঁট ও তালু কাটা, হাত ও পায়ের সমস্যা, পায়ুপথ ও মূত্রনালির রাস্তা বন্ধ থাকা—এসব সমস্যা মা-বাবারা দেখলেই বুঝতে পারবেন। খাওয়ার পর বারবার বমি করা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, পেট ফুলে যাওয়া, নীল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে শিশুর সমস্যা হচ্ছে। এ সময় চিকিত্সকের কাছে নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সঞ্জয় কুমার দে বলেন, জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে বেশির ভাগই হার্টের সমস্যায় ভোগে। সম্প্রতি আরো একটি গবেষণায় এর সপক্ষে প্রমাণ মিলেছে। এতে দেখা গেছে, চিকিত্সা নিতে আসা ত্রুটিযুক্ত শিশুর ১৪ শতাংশের হার্টে জন্মগত সমস্যা ছিল।
বিএসএমএমইউর শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ত্রুটিযুক্ত শিশুর হার কমাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী গর্ভধারণ, গর্ভকালীন চেকআপ, নিরাপদ প্রসব, নবজাতকের সঠিক পরিচর্যা—এগুলো ধাপে ধাপে নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া শিশুদের চিকিত্সা নিশ্চিত ও পরিকল্পনা প্রণয়নে এ সংক্রান্ত গবেষণা বড় ভূমিকা পালন করে।