এ বছর রোজাটা আসমা খানমের যেন রোজাই মনে হয়নি। কারণ আলিফ ছিল না। প্রত্যেক বছর আলিফ ভোরে সেহরি খেতে বাবা-মাকে ডেকে তুলত। সন্ধ্যায় ইফতারের আয়োজন বিছানায় শুয়ে শুয়েই করত। কখন বাবা-মা ওষুধ খাবে, নিজের ওষুধ সময় মতো খাওয়া সবই সে করেছে। এমন করে গত চার বছর আলিফ বিছানায় শুয়ে শুয়ে পরিবারের তদারকি করেছে। কিন্তু গত ১৭ ডিসেম্বর আসমার জীবনে আলিফের অধ্যায় শেষ হয়। ৩৬ বছর বয়সে মার্কেটিং-এ মাস্টার্স করা আলিফ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। চার বছর বিছানায় শুয়ে আলিফের একের পর এক শারীরিক জটিলতা ধরা পড়ে। কারণ, আলিফ মাহমুদ থ্যালাসেমিয়া রোগী ছিল। তার ভাই দেশও (২৪) থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। তাদের বাবা-মা থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ায় এ অবস্থার তৈরি হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ বলেছেন, দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এখন থেকে একে প্রতিরোধ করতে না পারলে আগামী প্রজন্মের নিরাপত্তা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক পরিবার চিকিৎসা ব্যয়ে নিঃস্ব হবে, দেশ হবে মেধাশূন্য। এজন্য অন্যতম প্রধান প্রতিরোধ হিসেবে বিজ্ঞ চিকিৎসকরা বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা বলেন, দেশে ১ কোটি ৮০ লাখ থ্যালাসেমিয়া বাহক বা রোগী আছে। থ্যালাসেমিয়া বাহকদের মধ্যে বিয়ে হলে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়। বিজ্ঞ চিকিৎসকরা আরও বলেন, ৫০ বছর পর আমাদের দেশের শতকরা ৫০ ভাগ লোক থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বা বাহক হবে।
কী এই থ্যালাসেমিয়া: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় চেয়ারম্যান ডা. এ টি এম আতিকুল ইসলাম বলেন, থ্যালাসেমিয়া একটি বংশানুক্রমিক রোগ, যা পিতা-মাতা বাহক হলে তাদের মাধ্যমে সন্তানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে ত্রুটি হয়। ফলে এই রোগে মানুষ অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতাসহ বিভিন্ন রকম জটিলতায় ভুগে থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রায় প্রতি মাসেই রক্ত দিতে হয়। কারো কারো মাসে একাধিকবার রক্তের প্রয়োজন হয়। ঘন ঘন রক্ত দেওয়ার ফলে এই রোগীদের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা যায়। হাড়ের ক্ষয় হয় যা আলিফের হয়েছে। শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমে যায়। ফলে বিভিন্ন রকম জটিলতা দেখা যেতে পারে। যেমন অবসাদ অনুভব করা, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি বৃদ্ধি, দুর্বলতা অনুভব করা, মুখের হাড়ের বিকৃতি, পেট বেশি বড় হয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও অন্যান্য হরমোনজনিত সমস্যা দেখা যায়। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বাচ্চাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তের চাহিদাও বেড়ে যায় ।
দেশের অবস্থা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশে জনগণের প্রায় ৭ শতাংশ থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা আক্রান্ত। কিন্তু বর্তমানে কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে জনগণের ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোক থ্যালাসেমিয়া বাহক বা রোগাক্রান্ত।
ব্যয়বহুল চিকিৎসা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক সৌমিত্র পাল বলেন, আমাদের হাসপাতালে বহির্বিভাগে প্রতিদিনই এই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যেহেতু থ্যালাসেমিয়া রোগীর মূল চিকিৎসা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। এটি একটি ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি। রক্ত নিয়ে রোগী বেঁচে থাকে। কিন্তু এই রোগের মূল চিকিৎসা হলো এর প্রতিরোধ করা। আমরা বলতে পারি থ্যালাসেমিয়া রোগী বা বাহক যাতে না তৈরি হতে পারে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসায় একজন রোগীর ২০-৩০ বছরের জীবনে রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে এবং এ সম্পর্কিত জটিলতায় যে পরিমাণ খরচ হয়। বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনে এর প্রায় দ্বিগুণ বা এর কাছাকাছি পরিমাণে খরচ হয়। ২০১৭ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর শুধু রক্ত সঞ্চালনের জন্যই প্রায় ১ দশমিক ৫ থেকে ২ লাখ টাকা বার্ষিক খরচ হয়। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
কী করতে হবে: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় চেয়ারম্যান ডা. এ টি এম আতিকুল ইসলাম বলেন, থ্যালাসেমিয়া নির্মূলে ‘প্রি-ম্যারিটাল থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং এবং আইডেন্টিফিকেশন অব থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার’ একটি কার্যকর পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে। এই পদ্ধতিতে বাহক যাচাই ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে, বাহকের সঙ্গে বাহকের বিয়ের ব্যাপারে নিরুত্সাহিত করতে হবে এবং সমাজে এর ভয়াবহতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে। তবে বাহকরা থ্যালাসেমিয়ামুক্ত মানুষকে বিয়ে করতে পারবেন। দরকার হলে এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্রে থ্যালাসেমিয়া স্ট্যাটাস ব্লাড গ্রুপের মতো করে উল্লেখ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি বিবাহ রেজিস্ট্রিতে থ্যালাসেমিয়া স্ট্যাটাস নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, আগামী ৫০ বছর পর আমাদের দেশের শতকরা ৫০ ভাগ লোক থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বা বাহক হবে। ফলে দেশ ও জাতি মেধাশূন্য ও কর্মক্ষমতা শূন্য হয়ে যাবে।