জিন ও জন্মগত রক্তশূন্যতাজনিত একটি রোগ থেলাসেমিয়া। দেশে এ রোগের বাহক প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। এদের বড় অংশই মাতৃগর্ভে থাকতে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বাবা-মা রোগটির বাহক হওয়ায় তাদের এ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে না করা ও বিয়ের আগে কেবল রক্ত পরীক্ষা করলেই বাবা-মা বাহক হলেও ৭৫ শতাংশ রোগী ও বাহক কমিয়ে আনা সম্ভব।
এমন পরিস্থিতিতে রোগটি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে সারা বিশ্বের মতো আজ ৮ মে, সোমবার দেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব থেলাসেমিয়া দিবস-২০২৩। আন্তর্জাতিক থেলাসেমিয়া ফেডারেশন এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে—‘বি অ্যাওয়ার, শেয়ার কেয়ার থ্যালাসেমিয়া :স্ট্রেনদেনিং এডুকেশন টু ব্রিজ দ্য থেলাসেমিয়া কেয়ার গ্যাপ। অর্থাৎ ‘থেলাসেমিয়া সম্পর্কে নিজে জানি, যত্নবান হই, সেবার গ্যাপ পূরণে জ্ঞান অর্জন করি।’
চিকিৎসকরা বলছেন, থেলাসেমিয়া রক্তের হিমোগ্লোবিন সম্পর্কিত জিনগত সমস্যা। বাবা-মা উভয়ই ত্রুটিযুক্ত জিন বহন করলে সে ক্ষেত্রে প্রতি গর্ভাবস্থায় সন্তানের ২৫ শতাংশ থেলাসেমিয়া রোগী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ২৫ শতাংশ সুস্থ এবং ৫০ শতাংশ বাহক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণ মানুষের চেয়ে এই রোগীদের শরীরে হিমোগ্লোবিন কম উৎপাদন হয়, অথবা ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। ফলে জন্মের এক বছরের মধ্যেই বাচ্চার রক্তশূন্যতা ও জন্ডিস হতে পারে। সংক্রমণ, হাড় ক্ষয় হতে পারে। নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালনের ফলে রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে অর্গান টিস্যুর ক্ষতি হয়। অনেকের হার্ট ফেইলিওর ও লিভারে সমস্যা দেখা দেয়। প্লীহা বড় হয়ে যায়। শিশুর আকার ও গড়নে ঘাটতি দেখা দেয়। যথাসময়ে চিকিৎসা না করালে ও সঠিকভাবে রোগটি ধরতে না পারলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
দেশে থেলাসেমিয়া রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকারি-বেসরকারিভাবে সেবাদাতাদের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ এর বাহক। অর্থাৎ ১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখের থেলাসেমিয়া রয়েছে। যাদের অধিকাংশ শনাক্তের বাইরে থাকছে। ফলে রক্তশূন্যতাসহ নানা কারণে অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেলাসেমিয়া সমিতি হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক ডা. এম একরামুল হোসেন বলেন, প্রটোকল ট্রিটমেন্ট অব থেলাসেমিয়া’ নামে আক্রান্তদের একধরনের চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হয়। এক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৯ মিলিমিটারে নেমে এলেই নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। আয়রন স্তর ১ হাজারের নিচে রাখতে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। একজন রোগীর বয়স ও ওজনভেদে প্রতি মাসে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু সবার পক্ষে খরচ বহন সম্ভব হয় না। সমিতির হাসপাতালে স্বল্প খরচে চিকিৎসা হলেও বেসরকারি মেডিক্যালে বেশি লাগে। তাছাড়া এ রোগের ওষুধগুলো বাইরের দেশের হওয়ায় দামও বেশি। ফলে অনেকে খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
সিলেট এমসি কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া দুই বছর বয়স থেকে থেলাসেমিয়া আক্রান্ত। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৪০০ ব্যাগের বেশি রক্ত নিয়েছেন। এজন্য প্রতিবার ঢাকায় আসতে হয়েছে। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের পূর্বে সিবিসি, এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া রোগের পরীক্ষা করাতে হয়। এরপর শুধুমাত্র রক্তের লাল অংশকে (আরবিসি) আলাদা করে দেহে প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি মাসে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সম্প্রতি শরীরে আয়রনজনিত কারণে হাড়ের ক্ষয় শুরু হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার নিতে বছরে দুই বার করে ভারতে যেতে হচ্ছে। প্রতি বার আড়াই লাখের বেশি টকা ব্যয় হচ্ছে।
দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন। রোগটির ভয়াবহতা, করণীয় এবং প্রতিরোধে জাতীয় পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। সকাল ৯টায় বিএসএমএমইউতে সাইন্টিফিক সেমিনার হবে। ‘রক্তিম সাহারা’ নামে একটি ওয়েবসাইট উদ্বোধন করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো থ্যালাসেমিয়া বাহক ও সেবাদাতাদের নিয়ে সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা ও লিফলেট বিতরণ করবে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় গুলশানে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালিত হবে।