শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হুন্ডির সুবিধাভোগী ৭৮০০ অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ

ডিজিটাল হুন্ডিতেই প্রবাসী আয়ে ধস

**প্রায় ৬ হাজার এমএফএস এজেন্টের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে **বিকাশের দুই ডিস্ট্রিবিউটরের ৫৩৭০ কোটি টাকার লেনদেনে সন্দেহ

আপডেট : ১২ মে ২০২৩, ০৩:৩০

প্রতি বছর ঈদের আগে প্রবাসী আয়ের নতুন নতুন রেকর্ড হলেও এ বছর ধস নেমেছিল এই খাতে। বৈশ্বিক সংকট মিলিয়ে গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে খারাপ সময় গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুসারে গত বছর এপ্রিল মাসে প্রবাসীদের কাছ থেকে দেশে আসে ২০১ কোটি ডলার। অথচ চলতি বছরে একই সময়ে এসেছে ১৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এ সময়ে প্রবাসী আয় অন্তত ১৭ শতাংশ কমে যাওয়ার পেছনে মূলত ডিজিটাল হুন্ডিই দায়ী। ডিজিটাল হুন্ডির সঙ্গে জড়িত প্রায় ৬ হাজার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাবের বিরুদ্ধে বর্তমানে তদন্ত চলছে। এ পর্যন্ত হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাওয়া ৭ হাজার ৮০০ অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর মধ্যে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনার শর্তে ৫ হাজার ৩০০ অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি আড়াই হাজার অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

হঠাত্ করেই হুন্ডি বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ইত্তেফাককে বলেন, ‘মূল কারণ হলো, খরচ। বৈধ পথে টাকা পাঠাতে গেলে যে খরচ হয় হুন্ডিতে তার খরচ অনেক কম। আরেকটা কারণ হলো, বৈধ পথে টাকা আসতে অন্তত ২৪ ঘণ্টা লেগে যায়। আর হুন্ডিতে একটা ফোন করতে যত সময় লাগে তার মধ্যেই টাকা চলে আসে। এখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনলে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যায়। এই প্রণোদনা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। আসল কথা হলো, এমএফএসের সেবা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাছেই পাওয়া যায় এজেন্ট। ফলে মানুষ ব্যক্তিগত সুবিধার কারণে এই পথে যাচ্ছে। সবাই তো আগে নিজের স্বার্থের কথা ভাববে, তারপর রাষ্ট্রের কথা। তাই হচ্ছে।’

গত ৩ মে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় ১৪ জনের বিপক্ষে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। মামলার অন্যতম আসামি শহরের আন্দরকিল্লার বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটর মেসার্স আল-কাদের অ্যান্ড কোম্পানি। পুলিশ এজাহারে জানিয়েছে, এই ডিস্ট্রিবিউটর প্রতিষ্ঠানটি এর আগের চার বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার লেনদেন করেছে, যার সিংহভাগই সন্দেহজনক লেনদেন। এজাহারে আরও বলা হয়, এই বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটর ৪৬ কোটি ২ লাখ ১৭ হাজার ১২৫ টাকা পাচারের উদ্দেশ্যে জমা করেছিল। এর কয়েক দিন আগে ফেনী জেলার বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটর রিয়াদ আহমেদ রাজীবের সঙ্গে ফেনীর হুন্ডি চক্রের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে সিআইডি ও বিএফআইইউ। গত এক বছরেই তার প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ৪৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে বলে মনে করছে আর্থিক গোয়েন্দারা। এর মধ্যে গত এক বছরেই তার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৯২৫ কোটি টাকা। বিপুল এ অর্থের ৯৯ শতাংশই জমা হয়েছে নগদ টাকায়। এ নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা হওয়া এবং বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটরশিপের আড়ালে ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বিপরীতে লেনদেন হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর মধ্যে অন্তত ৩৪৬ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে বলে বিএফআইইউ প্রমাণ পেয়েছে। বর্তমানে বিষয়টির অনুসন্ধান করছে সিআইডি।

সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া ইত্তেফাককে বলেন, ‘হুন্ডি বন্ধে, রেমিট্যান্স বাড়াতে সিআইডি-বিএফআইইউ একসঙ্গে কাজ করছে। অনেকগুলো সন্দেহজনক এমএফএস অ্যাকাউন্ট আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। বিশাল একটা সংখ্যার অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে আমরা তদন্ত করছি। এর মধ্যে অনেকগুলো এমএফএস ডিস্ট্রিবিউটার আর এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা সাফ বলে দিয়েছি, কোনো অ্যাকাউন্টে যদি হুন্ডির টাকা আসে তিনিও অভিযুক্ত হবেন। কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধেও মামলা করেছি। তদন্ত চলছে।’

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, এ পর্যন্ত তারা সিআইডিতে সন্দেহজনক ৫ হাজার ৮০০ জন এজেন্টের তালিকা দিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে অনুসদ্ধান চলছে। গত মাসেও অবৈধ ফরেক্স, বেটিং, ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের জন্য ৫১টি ওয়েবসাইট, ১২টি সোশ্যাল মিডিয়া পেজ ও ১৫টি অ্যাপ বন্ধ করা হয়েছে। তারা এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৮০০ জন হুন্ডির বেনিফিশিয়ারির হিসাব ফ্রিজ করেছে। এর মধ্যে আবার ৫ হাজার ৩০০ জনকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনার শর্তে তাদের অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। বাকি আড়াই হাজার অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ‘অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে যে লেনদেন হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই বিকাশের প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে। এ নিয়ে আমরা বিকাশের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের বিষয়টি অবহিত করেছি। এর মধ্যে বিকাশের কয়েক জন কর্মকর্তাও গ্রেফতার হয়েছেন। গত নভেম্বরে হুন্ডির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে বিকাশের কর্মকর্তাসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গত মাসেও প্রায় ৫০ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে পাচারের অভিযোগে বিকাশের আরও দুই এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে অবৈধ হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে যৌথভাবে তিনটি অভিযান চালিয়ে বিকাশের কর্মকর্তাসহ ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই হুন্ডি চক্রের সদস্যরা সে সময় চার মাসে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচার করে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তখন চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা, ঢাকার মোহাম্মদপুর এবং খিলগাঁও থানায় মানি লন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা হয়।’ কয়েক দিন আগে সিআইডি প্রধান বলেছেন, শুধু হুন্ডির কারণে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। এটা খুবই খারাপ খবর।

হুন্ডির সঙ্গে কেন বারবার বিকাশেরই নাম আসছে? জানতে চাইলে বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম ইত্তেফাককে বলেন, ‘যেসব এজেন্ট গ্রেফতার হচ্ছে তারা শুধু বিকাশের এজেন্ট নয়। তারা অন্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানের হয়েও কাজ করে।’ বিকাশের দুই ডিস্ট্রিবিউটরের বিরুদ্ধে ৫ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার লেনদেনে সন্দেহ করছে সিআইডি ও বিএফআইইউ। ডিস্ট্রিবিউটররা তো বিকাশের? জবাবে শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ‘বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর ছাড়াও তাদের অন্য ব্যবসা আছে। তারা কোন ব্যবসার টাকা কীভাবে লেনদেন করছেন সেটা তো তদন্তের বিষয়। আমাদের যে লেনদেন হয় সেটা তো ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে থাকে। সেখানে এদিক ওদিক করার সুযোগ নেই। এছাড়া আমরা নিজেরাও কারও লেনদেনে সন্দেহ হলে সেটা দ্রুত বিএফআইইউকে অবহিত করি। সেই লেনদেন বন্ধ করে দিই।’

বিএফআইইউ-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি বিকাশ আর্জেটিনা ফুটবল দলের আঞ্চলিক স্পন্সরশিপে যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ডলার-সংকটের মধ্যে বিকাশ এই বিশাল অঙ্কের ডলার কীভাবে পরিশোধ করেছে সেটাও আমরা তদন্ত করে দেখব। তবে শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ‘আইন কানুন মেনেই এটা করা হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের অনুমতি নিয়েই এই স্পন্সরশিপে যুক্ত হয়েছি।’

ইত্তেফাক/এমএএম