শুক্রবার, ০৯ জুন ২০২৩, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না: সমরেশ মজুমদার

আপডেট : ১২ মে ২০২৩, ২০:৩২

[সমরেশ মজুমদারের সাক্ষাত্কারটি ২০০৪ সালের। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের মাধ্যমে কলকাতা থেকে সমরেশ মজুমদারের চার হাজার শব্দের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেই সাক্ষাৎকারের প্রাসঙ্গিক চুম্বক অংশ পত্রস্থ করা হলো। সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ করেছেন কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার তাপস কুমার দত্ত]

তাপস কুমার দত্ত : আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা এসেছে কখনো?

সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এলো, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—‘কালবেলা’। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ওরকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি জানায়নি।

নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?

সমরেশ মজুমদার : তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...

এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?

সমরেশ মজুমদার : না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উত্সারিত আলো’—এ তিনটি।

অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।

সমরেশ মজুমদার : ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয় কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।

কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...

সমরেশ মজুমদার : হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তান-সন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উত্সর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে, বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠকের সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপি গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালি’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?

ধরুন, হাইপোথেটিকালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?

সমরেশ মজুমদার : চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনও অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝে-মধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই তা আমি নেব না কেন?

আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?

সমরেশ মজুমদার : শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।

তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হাল চাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...

সমরেশ মজুমদার : অবশ্যই।

বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...

সমরেশ মজুমদার : এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।

বইটার নাম কী?

সমরেশ মজুমদার : ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?

ঐ বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।

সমরেশ মজুমদার : এসব তো অনেক বইতেই আছে।

হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।

সমরেশ মজুমদার : তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?

না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ঐ লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।

সমরেশ মজুমদার : যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?

সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।

সমরেশ মজুমদার : তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যে কোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।

বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?

সমরেশ মজুমদার : আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।

পাঠকরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?

সমরেশ মজুমদার : না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝে-মধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?

তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।

আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?

তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।

এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্র্যাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।

আমি বললাম, তার মানে?

তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।

বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?

সমরেশ মজুমদার : না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।

আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।

সমরেশ মজুমদার : আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন