শুক্রবার, ০৯ জুন ২০২৩, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ঝিলটুলী 

মৃণালের শিল্পসত্তার সূতিকাগার

আপডেট : ১২ মে ২০২৩, ২১:২৭

১৯৩৬ সাল। ফরিদপুর শহরের সুবিখ্যাত ‘অরোরা টকিজ’ সিনেমা হলে চলছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে বাংলা সিনেমা ‘কপালকুণ্ডলা’। কলকাতা থেকে নতুন সিনেমা এলেই শহরের সে সময় একান্নবর্তী পরিবারের গণ্ডিতে দিনযাপন করা উত্সাহী পরিবারগুলো দলবেঁধে দেখতে আসে।

সেকালের বোবা সিনেমা, অর্থাৎ কোনো শব্দ নেই, নির্বাক। তবুও দেখা চাই। নির্বাক, কিন্তু তাতে কী! প্রায় নব্বই বছর আগের ফরিদপুর শহরটার চেহারা একবার ভাবুন। ছোট্ট টাউন। সন্ধ্যার পর অবাক করে ভূত নামে। পৌর সংস্থা দুই-এক রাস্তায় তেলের বাতি লাগিয়েছে। একটিমাত্র মোটরগাড়ি। টাউনের ছোট রাস্তায় যখন চলে লোকজন, হা করে দেখে। টাউনের আটটি ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে তুলনা করলে বিস্মিত হতে হয়।

ব্রিটিশশাসিত অখণ্ড ভারতের প্রায় সব বড় শহরে পশ্চিমাদের নিত্য-নতুন আবিষ্কার এবং কারখানার তৈরি জিনিসপত্র লন্ডন হয়ে চলে আসে বন্দরগুলোতে। যখন কাছের শহর কলকাতার বন্দরে জাহাজ ভিড়ল, কাঠের বাক্সের ভেতরে বিশাল এক যন্ত্র আসছে জেনে বিপুল উত্সাহে কাস্টমস কর্মকর্তারা দেখতে চাইল জাদুর বাক্সের ভেতরে কী কৌতূহল অপেক্ষা করছে। কলকাতার জন্য অপেক্ষা করছিল তত্কালীন জগতের সবচাইতে যুগান্তকারী আবিষ্কার সিনেমা হলের বিশাল প্রজেক্টর।

কলকাতার ভাগ্যে যখন ক্যামেরা চলে আসে, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সেটি ছিল ইতিহাসের আরেক বিস্ময়! সবে তখন ফটোগ্রাফির স্টুডিওর আবির্ভাব। মধ্য ও সম্ভ্রান্ত বাঙালির দীর্ঘদিনের চাহিদা পোর্ট্রেট পেইন্টিং, যা ছিল অত্যন্ত ব্যয়ের, তা থেকে সহজ ও দ্রুত সময়ে; কিন্তু হাতে আঁকা ছবি থেকে অনেক কম ব্যয়ে ফটোগ্রাফ তুলে নেওয়ার অগ্রযাত্রায় শামিল হলো ভারতবর্ষের রমণীয় শহর কলকাতা। ফিরিঙ্গিবাজার বা চীনাবাজারে ব্যস্ত রাস্তায় সরু চোঙা হাতে দীর্ঘ আওয়াজ “‘মশাই’ চেহারা উঠাইয়া যান”। কমার্শিয়াল স্টুডিওতে ঢুকে ফিটফাট শিক্ষিত বাবুরা হতবাক। ভেতরে ঢুকেই ভড়কে যেতে হতো স্ট্যান্ডে বক্স ক্যামেরা দেখে। স্টুডিওর ভেতরে সবকিছুকে ছাড়িয়ে নব্য প্রযুক্তির ক্যামেরার চোখ আটকে যাবেই।

এটি স্থির চিত্র। কিন্তু চলমান ছবি বা সিনেমাটোগ্রাফি অথবা সিনেমা আবিষ্কারের কয়েক বছর পর কলকাতায় চলে আসে আরেক বিস্ময়। প্রজেক্টর। এমন পরিস্থিতির প্রাথমিক দিনগুলোতে সত্যজিৎ-মৃণাল সেন-ঋত্বিক ঘটকদের আবির্ভাব হয়নি। কলকাতা যখন বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো উপভোগ করছে, শিক্ষা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের অন্তর্জালে পূর্ববাংলা তখন ঘুমন্ত, প্রায় উদাসীন। ব্রিটিশদের আমদানি করা নিত্য আবিষ্কার ঢাকা স্বাগত জানাতে পারল না। সিনেমা কলকাতাতেই থেকে গেল।

কিন্তু ফরিদপুরের ঝিলটুলীর জন্ম অনেক আগেই। ওর ভৌগোলিক অবস্থান কলকাতা থেকে খুব দূরে না। পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট ছিমছাম ও নীরব টাউন ফরিদপুরের পেটের ভেতর বসবাস ঝিলটুলীর। এখানে প্রকৃতি উদার ও একতরফা উদাস। এখানকার নয়নাভিরাম প্রকৃতি যেন নীরবে কাঁদে। রুপালি ইলিশের শহরে পথিকের আনন্দ বিস্তারিত হয়। কুমার ও পদ্মা নদীর সম্মিলনে ফুরফুরে হাওয়া শিহরণ জাগায়, যখন মহাত্মা গান্ধীজী উন্মুক্ত ঘোড়ার গাড়িতে স্কুলশিক্ষক মহসীন উদ্দীন খানকে পাশে বসিয়ে ঝিলটুলীর নতুন সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন, মাথার ওপর সূর্যসমেত আকাশ, কিন্তু সারি সারি নারকেল-সুপারি-তাল গাছেরা ছায়া বিতরণ করে। আড়চোখে শিক্ষক দেখে মহাত্মা লম্বা শ্বাস নিচ্ছেন ক্রমাগত, বললেন ‘বিউটি লাইস অন দ্যা স্কাই। হোয়াট অ্যা পিসফুল...ওহ গড!’

ঝিলটুলীর ‘তীর্থ নিবাস’। শীলকড়ই, নারকেল, আম আর খেজুর গাছের ফাঁক দিয়ে একতলা সাদা বাড়িটার কিছু অংশ দেখা যায়। সামনে গাছজুড়ে লাল জবা দুলছে। এই পরিবেশের মধ্যে গফুর গাড়োয়ানের ভারী গলায় ঐ রা রা বাহ্ চিত্কারে ঘোড়া ব্রেক করে। গান্ধীজীর পাশে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় মহসীন মাস্টার বসা। উলটো সিটে কংগ্রেস নেত্রী সরোজিনী নাইডু, পাশে বসলেন তীর্থ নিবাসের উকিল দীনেশ সেন। পেছনে কয়েকজন নেতা যুবক ও ভলান্টিয়ার। ওরা যাচ্ছে জুবিলি ট্যাংকের ময়দানে। সভা হবে। হঠাৎ গান্ধীজী দীনেশ এবং মহসীনের মুখে চোখ রাখলেন, তিনি জানতে চাইলেন শহরে হিন্দু-মুসলমানের কোনো বিবাদ আছে কি না, শান্তি ও সৌহার্দ্যের কী অবস্থা। দুই দিক থেকে দুই জনেই ধীরে বললেন, এখানে কোনো ধর্মীয় উসকানি কখনোই ছিল না, এখনো নেই। গোল পুরু চশমার লেন্সের ওপর আলো ঠিকের পড়ছে। গান্ধীজি বললেন—‘নেচার অ্যান্ড রিলিজিওন উইদ পিস ক্যান গ্লোরিফাই ফ্রিডম।’ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—হুম।

জন্ম : ১৯২৩ সালের ১৪ মে, বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ঝিলটুলী মহল্লায়।

পড়ালেখা : প্রথমে ফরিদপুর, তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি।

প্রথম পেশা : সাংবাদিকতা, ওষুধ বিপণনকারী এবং চলচ্চিত্রে শব্দ কলাকুশলী।

ছবি : ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় প্রথম ছবি ‘রাতভোর’। পরবর্তী ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৮)। এই ছবিটি সরকার দুই মাসের জন্য বাজেয়াপ্ত করে রেখেছিল। তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে।  এই ছবির দ্বারা তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে পরিচিতি পান। ১৯৬৯ সালে ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সালের ভিতরে মুক্তি পায় কলকাতা ট্রিলোজি নামে খ্যাত ‘ইন্টারভিউ’, ‘ক্যালকাটা ৭১’, ‘পদাতিক’) মুক্তি পায়। এ ছাড়া ‘খারিজ’, ‘জেনেসিস’সহ তিনি সর্বমোট ২৭টি কাহিনিচিত্র, ১৪টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি, ৪টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা :

১৯৮১ : ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ।

২০০৫ : দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ।

১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতীয় সংসদের সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। ফরাসি সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘কম্যান্ডার অফ দি অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস’-এ ভূষিত করে

ঝিলটুলী ফেলে ঘোড়ার গাড়ি জুবিলি ট্যাংকের কোলাহলের মধ্যে এসে দাঁড়ায়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সভা করতে বসে ঝিলটুলীর ভেতর দিয়ে কর্মীদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। কলেজের ছাত্র ও ছাত্রীরা বহর আটকে দিল, কপালে তিলক আর নানা রঙের ফুলের মালায় ঢাকা পরল ভারতবর্ষের মহান বিপ্লবীর মুখচ্ছবি। এমন সম্মান দিতে পারে ঝিলটুলী। কয়েকবার ফরিদপুরে এসে থেকেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। আম্বিকাপুরে গাছের ছায়ায় বসে লিখেছেন কবিতা—

‘আকাশেতে একলা দোলে একাদশীর চাঁদ

নদীর তীরে ডিঙি বাঁধা পথিক ধরা ফাঁদ।’

জসীমউদ্দীনের সঙ্গে তীর্থ নিবাসে বসেছিলেন কবি নজরুল। প্রায় বাড়ির পেছনে পুকুর, সামনে ফুলের বাগান দেখে কবি বলেছিলেন কবিতা ও গান রচনার আদর্শ জায়গা। তখন ঝিলটুলীতে ফল আর ফুলের সমারোহ। শহরের শিক্ষিত ও বনেদি পরিবারগুলো এখানে বসবাস করে, যাদের নিয়মিত যাতায়াত মহানগরী কলকাতায়, যেখানে যেতে সময় লাগে মাত্র ছয় ঘণ্টা।

বিদ্রোহী কবি একবার ফরিদপুর শহর থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। প্রচার করতে বাড়িতে বাড়িতে গেছেন একদল যুবক, ভলান্টিয়ার এবং কবি জসীমউদ্দীন। ঝিলটুলীর সেনদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, একটা ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে এসে ফুলের মালা নিয়ে কবির কোলে উঠে গলায় জড়িয়ে দিল।

মৃণাল সেনের ছোট বোন। ওর নাম রেবা। ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন কবি। ঝিলটুলীর বাড়িঘর ছেড়ে বিদ্রোহী কবিকে দেখতে বেরিয়ে এলো ছাত্রছাত্রীরা, গৃহিণীরা রান্নাঘর থেকে চামচ-খন্তি ফেলে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ওঁর রচিত গান ঝিলটুলীর গ্রামোফোন থেকে বেজে ওঠে। কবি কান পাতেন ঐদিকে, কিন্তু ছাত্র-যুবকদের ভিড় ঠেলে নিয়ে যায় কবিকে। বিকেলে মিটিং। আব্বাসউদ্দীন গান করবেন। ঝিলটুলী এই খুশিতে নেচে ওঠে।

মৃণাল সেন যখন ঈশান স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র; ‘অরোরা টকিজ’-এ তার সিনেমা দেখার উদ্বোধন করল ‘কপালকুণ্ডলা’ ছায়াছবি দিয়ে। কলকাতা থেকে সাদাকালো রোল ফিল্মে ছায়াছবিটি চলছিল। হলভরতি দর্শক। ফরিদপুর শহরে যেন অবাক করা নতুন অতিথি, যারা তখন কলকাতায় গিয়ে সিনেমা হলে যায়নি তাদের জন্য তো রীতিমতো মহাবিস্ময়। হলের ঠিক মাঝখানে মহীম সেনের নাতি দীনেশ সেনের কনিষ্ঠ সন্তান কৌতূহলী মৃণাল আগেই দর্শকদের সবাইকে প্যান করে দেখে নেয়। তারপর নির্ধারিত আসনে বসে; কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে কতক্ষণ। সামনের সাদা বড়পর্দায় তার জন্য কী অপেক্ষা করছে এবং কীভাবে তা শুরু হবে, চলমান ছবি তো। প্রথমে পর্দায় বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা কয়েকটি নাম দেখা গেল। দ্রুত পড়তে পারল সে। সিনেমা শুরু হলো, সবার চোখ একদিকে। খুট-খাট সামান্য শব্দ, ছায়াছবি চলছে। হঠাৎ পেছন থেকে ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। অনেকক্ষণ। শান্তিতে দেখতে আসা দর্শকরা বিরক্ত। পর্দায় নায়ক ও নায়িকার প্রেমপর্ব চলছে। নায়িকা গাছে উঠে পেয়ারা খাচ্ছে, নায়ক নিচে।

মৃণাল সেন পর্দায় দেখল ঝড় শুরু হয়েছে। মাথার ওপর বৃষ্টি। নায়িকা ও নায়ক দৌড়ে নিরাপদ কোথাও পালাতে চাইছে। কোনো শব্দ নেই, সুনসান। নির্বাক ছবি, আওয়াজ আসবে কোত্থেকে। সিনেমা হলের বাইরে বাস্তবের ঝড় শুরু হয়েছে হঠাৎ। তুমুল বৃষ্টি। মৃণালের চোখ সাদা পর্দায় নির্বাক ছবিতে, কিন্তু কান হলের টিনের চালের বৃষ্টির শব্দের কাছে সমর্পিত। যেন বড়পর্দার নির্বাক ছবির আবহ তৈরি করে দিয়েছে হঠাৎ উঠে আসা ঝড়বৃষ্টি!

কিশোর মৃণাল সেদিন বুঝতে পারল শব্দ ছাড়া ছায়াছবি জমে ওঠে না। তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, ছায়াছবি তৈরি করবে। কিন্তু নির্বাক নয়, সবাক। ১৯৪০-এ মৃণাল সেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে কলকাতায় চলে গেলেন। কয়েক মাস পর চলচ্চিত্রে শব্দ গ্রহণের ওপর দুই মাসের একটি প্রশিক্ষণ শেষ করে ছায়াছবিতে যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেন। হ্যাঁ, সবাক ছবি।

ঝিলটুলী থেকে মৃণাল সেন উধাও হলেন বটে; কিন্তু অপূর্ণতা থেকে ওঁর ভেতরে ছায়াছবির যে আয়ু-পরমায়ু সংক্রমিত হলো, যা তাঁর চলচ্চিত্রের দীর্ঘ ভ্রমণে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে নাড়া দিয়েছিল। বাংলা সিনেমা আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছে। সময়ের কঠিন বাস্তবতা তাঁর ছবিকে মহিমান্বিত করেছে। তিনি আমাদের চলমান দৃশ্যশিল্পের মহান রূপকার। জন্মশতবর্ষে মৃণাল সেনকে অভিবাদন।

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন