বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় মোখা ক্রমশ: ভয়ংকর দানবীয় শক্তিতে উপকূলভাগের দিকে ধেয়ে আসছে। ঝড় কেন্দ্রের কাছে ঘণ্টায় ২০৫ কিলোমিটার গতির বাতাসের ঘূর্ননচক্র মহাশক্তি নিয়ে গতকাল মধ্যরাতে বাংলাদেশ উপকূল থেকে ৮ শত কিলোমিটারের মধ্যে এসে পৌঁছেছিল। বিক্ষুব্ধ সাগর বিকট শব্দ-নিনাদে ফুঁসছিল। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর ভয়ংকর হয়ে ওঠায় দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতি দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা উপকূলে প্রলয় তাণ্ডবের আশঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, ভয়ংকর গতিতে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে মোখা। আগামীকাল রবিবার সকাল নাগাদ ঝড়ের অগ্রভাগ আঘাত হানতে শুরু করবে কক্সবাজার-টেকনাফ ও মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী ভূভাগে। আমেরিকার জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারে সর্বশেষ বুলেটিনে ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিকাল থেকে উপকূলভাগে আকাশ মেঘলা করে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সৈকতে ঢেউ বাড়ছে। টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার বলছে, আঘাতের সময় ২০০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে মোখার ঘূর্ণিবাতাসের শক্তি। এদিকে উপকূলভাগের মানুষজন ঘূর্ণিঝড় ও প্রবল জলোচ্ছাসের আতংকের আবর্তে পড়েছেন। বিশেষ করে যেসব এলাকায় বেড়িবাধ নেই সেখানকার লোকজন বেশি আতংকিত। সরকার ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে।
১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হতে পারে
‘মোখা’ আগামীকাল রোববার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, মোখা সুপার সাইক্লোনে পরিণত হতে পারে। এই ঘূর্ণিঝড়টির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ব্যাস, কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ সবই বাড়ছে। তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষকে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আজ সন্ধ্যা নাগাদ উপকূলীয় চট্টগ্রাম,খুলনা, বরিশালের মত উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। আজিজুর রহমান বলেন, সেন্টমার্টিনের খুব কাছ দিয়ে ঘূর্ণিঝড় মোখার সেন্টার পয়েন্ট বা অগ্রভাগ অতিক্রম করবে। ঝড়ের অগ্রভাগ যেদিক দিয়ে যাবে, সেখানে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হতে পারে।
সেন্টমার্টিনের সব হোটেল-মোটেল-রিসোর্টকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা
কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে ট্রলারযোগে দ্বীপ ছেড়ে টেকনাফে আসতে শুরু করেছেন। গতকাল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষ দ্বীপ ছেড়েছে। এ অবস্থায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সব হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, দ্বীপে ১৭টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্র নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবকরা একযোগে কাজ করছেন।
সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে: প্রতিমন্ত্রী
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কক্সবাজারের জন্য ৫৭৩টি আশ্রয়ণ প্রকল্প খোলা হয়েছে। প্রায় ৮ হাজার ৪০০ সিপিবি ভলান্টিয়ার সেখানে কাজ করছেন। এছাড়া কোস্টগার্ড কাজ করছে। আমরা কন্ট্রোল রুম থেকে সার্বক্ষণিক খবর নিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, মোখার যে পেরিফেরাল পার্ট আছে তা ৪০০ কিলোমিটার ব্যাস নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ পেরিফেরাল পার্ট সেন্ট মার্টিন এবং টেকনাফে আঘাত হানতে পারে। ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন এবং এটি মোকাবিলায় প্রস্তুতি সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। আমরা চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছি। সমন্বিতভাবে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা এবং উদ্ধার তৎপরতা নিশ্চিত করতে আজ শনিবার সকালে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে অ্যালার্ট-২ জারি
‘মোখা’র কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে ‘অ্যালার্ট-২’ জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর মোখার কারণে ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত জারির পর বন্দর কর্তৃপক্ষ গতকাল শুক্রবার নিজস্ব এ অ্যালার্ট জারি করে। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, অ্যালার্ট-২ জারির পর লাইটার জাহাজগুলোতে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন,এখনো বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়নি। যদি ‘অ্যালার্ট-৫’ জারি করা হয় তখন বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
‘রোহিঙ্গা শিবিরের ঘরগুলোর তেমন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই’
কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার পুরো জেলার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি। পুরো কক্সবাজার জেলার প্রায় ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসার ভবনগুলো (যেখানে খাবার পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা আছে) আশ্রয় কাজে যাতে ব্যবহার করতে পারি, সেই প্রস্তুতিও চলছে। মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসরত ১০ লাখ মানুষের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরের ঘরগুলো নিচু,তাই বাতাসে তেমন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বেশি হলে ক্ষতিও বেশি হতে পারে। তবে এই ১০ লাখ মানুষকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের কোনো ব্যবস্থা বা অনুমতি আমাদের নেই।