ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রভাগ কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূল স্পর্শ করতে যাচ্ছে। কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ ইত্তেফাক অনলাইনকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী মোখার বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ পাওয়া গেছে ২৪০ কিলোমিটারের বেশি। রবিবার প্রথম প্রহরে রাত ৩টার দিকে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আঘাত হানবে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
এর আগে শনিবার রাত ৯টায় দেওয়া ১৬ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ঘূর্ণিঝড় মোখা ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে আসছে। আর গতি বেড়ে যাওয়ার কারণে আজ মধ্যরাতেই চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় এর অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হতে পারে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টির চলার গতিবেগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ কিলোমিটারে। এর আগের দুইদিনের তুলনায় মোখার গতিবেগ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, ফলে এটি দ্রুত উপকূলের দিকে এগোচ্ছে।
আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী মোখা শনিবার সন্ধ্যার পর সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর এটিকে 'সুপার সাইক্লোন' হিসেবে আখ্যা না দিয়ে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবেই উল্লেখ করেছে। সামুদ্রিক ঝড়গুলোর শক্তির বিচারে যে শ্রেণীভেদ করা হয়, তার সর্বোচ্চ ধাপে রয়েছে ‘সুপার সাইক্লোন’। কোনো ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার ছাড়ালে তাকে সুপার সাইক্লোন বলা হয়। অবশ্য মোখা সুপার সাইক্লোন হোক বা না হোক, এর ধ্বংস ক্ষমতা কম হবে— এমন ভাবার কোনো সুযোগ নেই বলে সতর্ক করছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা। ঘূর্ণিঝড় মোখার ব্যাস ৫০০ কিলোমিটারের বেশি হওয়ায় এর অগ্রভাগের প্রভাব অনেক এলাকায় পড়বে বলে মনে করছেন তারা। কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনকেই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
শনিবার (১৩ মে) দুপুরে আবহাওয়া অধিদপ্তরের জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, মোখা সিডরের মতোই শক্তিশালী। প্রবল গতিবেগ নিয়ে এটি উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। তবে সিডর বাংলাদেশের মাঝ বরাবর দিয়ে গিয়েছিল, এটি পাশ দিয়ে যাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় সিডর ২০০৭ সালে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হেনেছিল। সিডরের তাণ্ডবে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। তবে অনেকের ধারণা এই সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণও হতে পারে। এরপর আরও বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় হলেও তাতে খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, মোখার কেন্দ্রের পুরোটা কক্সবাজার জেলার ওপর দিয়ে অতিক্রম করার আশঙ্কা বেশি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মডেল থেকে প্রাপ্ত পূর্বাভাস অনুসারে ঘূর্ণিঝড় মোখার স্থলভাগে আঘাতের প্রথম স্থান সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। এরপরে কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় সব উপজেলা। ঘূর্ণিঝড়টির স্থলভাগে আঘাতের সব সম্ভাব্য পথনির্দেশ করছে যেসব রেখা, তার প্রায় সবগুলোই কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকাগুলোর ওপর দিয়ে গেছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মোখা স্থলভাগে আঘাতের আশঙ্কা ৯০ শতাংশের বেশি।
তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র রবিবার সকাল থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করার আশঙ্কা বেশি। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব পুরোপুরি কেটে যেতে রবিবার মধ্যরাত পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। মোখা যখন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আঘাত করবে, তখন দ্বীপটি ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এতে সেখানকার অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পাশাপাশি প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। দ্বীপের ভূকাঠামোর স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছি।
এই তরুণ গবেষক আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ২৫০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার, বরিশাল বিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোর ওপর ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছি। অতিবৃষ্টির কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোসহ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে বন্যা, ভূমিধস ঘটতে পারে। কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী দ্বীপসহ অন্য উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুট, বরিশাল বিভাগের অন্য জেলাগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুট এবং খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবেলার প্রস্তুতি প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের বড় একটি অংশকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দাদের অনেককেই সেখান থেকে আনা সম্ভব হয়নি। তাদের স্থানীয় হোটেল–মোটেলে রাখা হয়েছে। সেখানে সাত দিনের খাবার মজুত আছে।
এর আগে শুক্রবার (১২ মে) কক্সবাজার ও এর আশপাশের দ্বীপ ও চরে ১০ নম্বর মহাবিপদসংকেত জারি করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। উপকূলবর্তী আরও ১১টি জেলা এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরে জারি করা হয়েছে ৮ নম্বর মহাবিপদসংকেত।