সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

একুশের গানে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ 

আপডেট : ১৯ মে ২০২৩, ০৫:৫৬

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বেঁচে থাকবেন একুশের প্রভাতফেরির ভোরে, ভাষা আন্দোলনের প্রেরণায়। গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যু নেই। তিনি আমাদের মাঝে বারবার ফিরে আসবেন। গাফ্ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। তাদের অবদান ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে। গাফ্ফার চৌধুরী বেঁচে থাকবেন তার কালজয়ী গান ও লেখনীর মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। প্রভাতফেরির ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের সুরে ভেসে তিনি বারে বারে ফিরে আসেন বাঙালির হৃদয়ে।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বাঙালি জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে উজ্জীবিত করেছে। ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করেই বাঙালি জাতিসত্তা নির্মিত হয়েছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এ অবদানের জন্য বাংলাদেশ তাকে কখনো ভুলবে না। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালির বসবাস, যতদূর বাংলা ভাষা থাকবে, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার একুশের গানের সুরে সেখানে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। আজ অমর একুশের গানের রচয়িতা, কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত বছরের এই দিনে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তার চলে যাওয়া যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে তা পূরণ হয়নি। তার চলে যাওয়ার পর সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে।

দৈনিক ইত্তেফাক-এর সঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ছিল নাড়ির বন্ধন। ২০১৫ সালে ইত্তেফাক-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এক লেখায় তিনি তা উল্লেখও করেছেন— “ইত্তেফাকের সঙ্গে একদিন আমি যুক্ত ছিলাম এবং এখনো আছি—এটা আমার কলামিস্ট জীবনের সব থেকে বড় গৌরব। সম্ভবত মানিক মিয়ার ছায়ায় আমরা যারা তরুণ বয়সে সাংবাদিকতা শিখেছি, পেশাজীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি, তাদের মধ্যে হয়তো আমিই সব থেকে বর্ষীয়ান এবং ‘লাস্ট অব দ্য মহিকানস’। আমি একদিন থাকব না কিন্তু ইত্তেফাক থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগী হয়ে তাদের পথ দেখাবে—এটা আমার বিশ্বাস।”

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, সরকার পরিচালনার নানা বিষয় নিয়ে লন্ডন থেকে নিয়মিত সংবাদপত্রে কলাম লিখতেন। সেসব লেখায় সরকারের সমালোচনা যেমন করতেন, তেমনি প্রশংসাও করতেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ে তুলবার দিকনির্দেশনা থাকত তার লেখায়। সেখান থেকে সাধারণ মানুষ জানতে পারত দেশের নানা বাঁক বদলের তথ্য। শুধু বাংলাদেশ না সারা বিশ্বের রাজনীতির গতি-প্রকৃতিও উঠে আসত তার লেখায়।

সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন পদক্ষেপেরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন তিনি। সরকার পরিচালনার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও মানুষের সামগ্রিক উন্নতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, ‘সন্ত্রাস দমন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, দেশের উন্নয়ন—এসবের কোনো কিছুই শেখ হাসিনা না থাকলে সম্ভব হতো না।’ আবার সরকারের কড়া সমালোচনা করতেও তিনি পিছপা হতেন না। তবে মৃত্যুর আগে আওয়ামী লীগে স্বাধীনতা বিরোধীদের অনুপ্রবেশ নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কলামে বারবার লিখেছেন। যাতে তা দলের নীতি-নির্ধারকদের নজরে আসে।

গাফ্ফার চৌধুরী তার কলামের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। আবার সমাজের একটি অংশ তার লেখা কলাম খুব পছন্দ না করলেও তার লেখাকে অস্বীকার করতে পারত না, খণ্ডাতে পারত না। এতটাই যুক্তি-নির্ভর ছিল তার লেখনী। আর ইতিহাস তার লেখায় আয়নার মতো প্রতিফলিত হতো। এতটাই প্রখর ছিল তার স্মৃতিশক্তি। কলাম লেখার পাশাপাশি লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধ।

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী ’৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারির শহিদদের স্মরণে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংগীতটি রচনা করেছিলেন এবং যিনি আজীবন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহধন্য সাংবাদিক ও লেখক। তার লেখনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও আদর্শকে অকৃপণভাবে তুলে ধরেছেন। এ দেশের জনগণ ও সংবাদপত্রসেবীদের জন্য তিনি ছিলেন এক বাতিঘর। তার মৃত্যুতে আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তি ও সাংবাদিকতার জগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।

সংক্ষিপ্ত জীবনী: ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামের জমিদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। ছাত্রজীবন থেকেই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। ১৯৫০ সালে তিনি পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায় যোগদান করেন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ঐ বছরই তিনি প্যারামাউন্ট  প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা ‘মেঘনা’র সম্পাদক হন। এরপর তিনি দৈনিক আজাদ-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ  দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় যুক্ত হন এবং ‘অণুপম মুদ্রণ’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বছর পরই আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে তিনি দৈনিক ‘আওয়াজ’ বের করেন। পত্রিকাটি ছয় দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি দৈনিক আজাদে ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে পুনরায় ফিরে যান দৈনিক ইত্তেফাকে। পরবর্তী সময়ে তিনি অবজারভার গ্রুপের  দৈনিক পূর্বদেশ-এ যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক জনপদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপাত্র সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’য় লেখালেখি করেন। এ সময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। প্রবাসে বসেও গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখে  গেছেন।

তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩৬টি। এছাড়া তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছেন। ‘দ্য পোয়েট অব পলিটিকস’ শিরোনামের চলচ্চিত্রের প্রযোজনা করেছেন। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ১৯৬৩ সালে ইউনেসকো পুরস্কার পান। এছাড়া তিনি একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পদকসহ বাংলাদেশের প্রধান পুরস্কারের প্রায় সব কটিই পেয়েছেন।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন