রোববার, ২৮ মে ২০২৩, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিপিসির বিশাল দেনা, সংকটের আশঙ্কায় বাংলাদেশ

আপডেট : ১৯ মে ২০২৩, ২১:৪৮

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ডলার সংকটের কারণে বিদেশের জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের পাওনা শোধ করতে পারছে না। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল এই তথ্য দিয়ে জানিয়েছে যে, জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন বাংলাদেশের তেল আমদানিকারক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসির কাছে পাওনা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। ডলার সংকটের কারণে তারা এই পাওনা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। পাওনা না পেলে বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বিপিসির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) খালিদ আহম্মেদ জানিয়েছেন,কিছু সরবরাহকারী তাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছে দ্রুত বকেয়া পরিশোধ না করলে তারা সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।’’ তবে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করেননি।

তবে জানা গেছে, বিপিসিকে বর্তমানে জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে ৬টি প্রতিষ্ঠান। বকেয়া পরিশোধ না করায় এর মধ্যে দুইটি প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে অনীহা প্রকাশ করেছে। ডলার সংকটের কারণে বিপিসি সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভিটল এশিয়া এবং চীনা প্রতিষ্ঠান ইউনিপেককে মোট প্রায় ২৮২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে পারেনি।

১৬ মে পর্যন্ত জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপিসির কাছে বকেয়ার পরিমাণ ২৯৭.৪৯ মিলিয়ন ডলার। এর প্রায় পুরোটাই ওই দুইটি প্রতিষ্ঠানের পাওনা বকেয়া।

গত কয়েক মাস ধরে বিপিসি কিছু প্রতিষ্ঠানকে মোট বকেয়ার এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পরিশোধ করে আসছে। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠানকে তারা কোনো বকেয়াই পরিশোধ করতে পারেনি। রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং ডলার সংকটের কারণে বিপিসি এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।

খালিদ আহম্মেদ বলেন, ‘বিপিসি আগে কখনো এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। আমরা আগে সব সময়ই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধ করতাম।’

গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিপিসি জ্বালানি তেল জাহাজে লোড করার ৮-১০ দিনের মধ্যেই মূল্য পরিশোধ করতো। যদিও পরিশোধের সর্বোচ্চ সময় ৩০ দিন। কিন্তু মার্চ থেকে আর পুরো পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। বিপিসি তার আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম ডলারে পরিশোধ করলেও স্থানীয় বাজারে বাংলাদেশি টাকায় বিক্রি করে। ব্যাংক থেকে ডলার না পেলে তাই আমদানির মূল্য পরিশোধের ডলার তাদের হাতে থাকে না।

এ নিয়ে বিপিসি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে কথা বলেছে। কিন্তু তাতেও ডলার সংকটের কোনো সমাধান হয়নি বলে জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালক মেসবাউল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এ সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অবগত নই। আজ (শুক্রবার) ছুটির দিন। অফিস খোলার দিন হয়তো কাগজপত্র দেখে বলতে পারবো। তবে সার্বিকভাবে ডলার সংকট তো আছেই। রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে।’

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে বা দরপত্রের মাধ্যমে বিপিসি বছরে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি আমদানি করে।

জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিপিসিকে বছরে দুইবার দরপত্র আহ্বান করতে হয়। জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বরে। নির্ধারিত সরবরাহকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দাম ঠিক করা হয়। বিপিসি আশঙ্কা করছে যদি দ্রুত বকেয়া শোধ করা না হয় তাহলে সরবরাহকারীরা দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল আমদানি করার জন্য বিপিসিকে প্রতি মাসে প্রায় ৫৬০-৬৯৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ১৬ থেকে ১৭টি এলসি খুলতে হয়।

এদিকে বেসরকারি পাওয়ার প্ল্যান্টের মালিকরাও জ্বালানি তেল আমদানির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফয়সাল খান। বাংলাদেশের ক্রুড অয়েল আমদানি মার্চের তুলনায় এপ্রিলে ১২.৫ ভাগ কমে গেছে।

পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা জানি, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তেল সরবরাহ করবে না বলে জানিয়েছে। আবার নতুন করে তেল আনার জন্য বিপিসি এলসিও খুলতে পারছে না। এটা একটা সংকট। ডলার সংকট তো অনেক দিন ধরেই চলছে ফলে আমাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল। আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে না। তবে এর বাইরেও সংকট মোকাবিলায় আরও অনেক পদক্ষেপ নেয়া যেতো। হয়তো জ্বালানি তেলের এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে। সৌদি আরব ও কাতারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ডলার সংকটে কয়লাও তো আমদানি করা যাচ্ছে না। তেল-চালিত পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো বন্ধ আছে। কয়লারগুলোও বন্ধ হচ্ছে। তাহলে বিদ্যুতের অবস্থা কী হবে?’

এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানিয়েছেন এখন থেকে এক মাস পর পর আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে মিল রেখে দেশের বাজারে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। আর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নয়, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকার এ মূল্য নির্ধারণ করবে। তিনি শুক্রবার তার বাসভনে সাংবাদিকদের জানান, ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে এখন রিজার্ভের পরিমাণ ৩০.৩৬ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেসবাউল হক। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৫০৭ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার পর পরিস্থিতির এই সামান্য উন্নতি। এর আগে রিজার্ভ ছিল ২৯.৭৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ডলারের সঙ্গে টাকার আরও অবমূল্যায়ন হয়েছে। আমাদানি ও আন্তঃব্যাংক ডলারের দাম বেড়েছে। আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে ডলারের দাম গড়ে প্রায় এক টাকা বেড়েছে। এ খাতে ডলার ১০৮ থেকে ১০৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বৃদ্ধির হার প্রায় এক শতাংশ। একই সঙ্গে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দামও বেড়েছে গড়ে এক টাকা। প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা। আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে ডলারের দাম বাড়ায় পণ্য আমদানির খরচ বাড়বে।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকার এখন নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করছে। তারা নির্বাচন নিয়েই ভাবছে। কিন্তু এই সংকটগুলো মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দরকার। সারা বিশ্বই এটা মোকাবেলা করছে। আমাদেরও এটা মোকাবিলা করেই এগোতে হবে। আমরা যা দেখছি তা ফ্লোটিং। কোনো অ্যাংকরিং দেখছি না।’

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।

ইত্তেফাক/এএএম