দেশে লাগামহীনভাবে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজে দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এরমধ্যে গত চার দিনে বেড়েছে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা, যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। পেঁয়াজের পাশাপাশি ভোজ্য তেল, চিনি, আটা, ময়দা, ডিম, আদা সবকিছুর দামই বাড়তি। এমনকি চড়া সবজির বাজারও। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। তারা কাটছাঁট করেও সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শান্তিনগর ও কাওরানবাজারসহ কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ার এ চিত্র পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, বাজার যেন নিয়ন্ত্রণহীন। অসৎ ব্যবসায়ীরা একেক সময় একেক পণ্য নিয়ে কারসাজি করছেন। গত রমজানের সময় সিন্ডিকেট করে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ানো হয়। একই সময় চিনির বাজার ছিল লাগামহীন। চিনির বাজারের অস্থিরতার মধ্যেই কয়েক দিন আগে বাড়ানো হলো ভোজ্য তেলের দাম। এখন পেঁয়াজের দাম নিয়ে কারসাজি করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পেঁয়াজের বাম্পার ফলনের পরও বর্তমানে পণ্যটির দাম যেভাবে বাড়ছে, তা অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, দেশে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল রংপুরে সাংবাদিকদের বলেছেন, দু-এক দিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম না কমলে পেঁয়াজ আমদানি করবে সরকার। তিনি বলেন, পেঁয়াজ ও চিনি নিয়ে একটু ঝামেলা চলছে। তবে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হবে।
গতকাল রাজধানীর কয়েকটি খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে অনেক দোকানেই আমদানিকৃত পেঁয়াজ নেই। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজারদরের প্রতিবেদনেও পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। টিসিবির তথ্য বলছে, মাত্র এক মাস আগে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গতকাল কাওরানবাজারের এক পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বলেন, হঠাৎ করেই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। মোকাম ও পাইকারি বাজারে গত কয়েক দিনে পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, বাজারে আমদানিকৃত পেঁয়াজ নেই। ফলে দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ পড়েছে। সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিলে দাম কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। উল্লেখ্য, কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করে সরকার পেঁয়াজ আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা কত, উৎপাদন কত
দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। চলতি বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ ১০ থেকে ১২ লাখ টন পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে। সে হিসেবে চাহিদার তুলনায় প্রকৃত উৎপাদন দাঁড়াচ্ছে ২২ থেকে ২৪ লাখ টন, যা চাহিদার তুলনায় কম। কিন্তু দেশে বছরের মাঝামাঝি এই সময়ে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। গত রবিবার সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ সংক্রান্ত সভায় কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার জানিয়েছেন, এ বছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। আর বর্তমানে মজুত আছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। উৎপাদন ও মজুত বিবেচনায় দেশে এই মুহূর্তে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। অথচ বাজারে দাম কিছুটা বেশি। জানা গেছে, সীমিত পর্যায়ে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তারকে গত ১৪ মে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই কৃষি মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে।
পেঁয়াজের পাশাপাশি দাম বেড়েছে তেল, চিনি, আটা, ময়দা ও ডিমের
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের দামও বেড়েছে। গতকাল খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলে ৫ টাকা বেড়ে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া, ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ৯০৫ থেকে ৯৬০ টাকা ও এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবি বাজারদরের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এক মাস আগে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৬৮ থেকে ১৭৫ টাকা। আর ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৭০ থেকে ৮৯০ টাকা। এছাড়া দুই দিনের ব্যবধানে ময়দার দাম কেজিতে ২ টাকা বেড়ে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি প্যাকেট ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৫ টাকা। এই সময়ে আটার দাম না বাড়লেও বর্তমানে যে দরে আটা বিক্রি হচ্ছে তা বছরের সর্বোচ্চ দর। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি সাদা খোলা আটা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা ও প্যাকেট সাদা আটা ৬২ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়, যা এক বছর আগে বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা ও ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। লাগামহীন চিনির দামও। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি খুচরা চিনি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়, যা এক মাস আগে ছিল ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। আর এক বছর আগে ছিল ৭৮ থেকে ৮২ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দামও বেড়েছে। প্রতি হালি ডিমে ২ টাকা বেড়ে গতকাল বাজারে তা ৪৭ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে। এক মাস আগেও প্রতি হালি ডিম ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এদিকে গত এক মাস ধরে লাগামহীনভাবে বাড়ছে আদার দাম। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি দেশি আদা ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা ও আমদানিকৃত আদা মানভেদে ২৪০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি হয়। কিন্তু এক মাস আগে যথাক্রমে তা ২২০ থেকে ২৩০ টাকা ও ১৪০ থেকে ২৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।
টিসিবি জানিয়েছে, গত এক মাসের ব্যবধানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি আদার দাম ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ ও আমদানিকৃত আদা ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, কৃষকের উপকারের জন্য আমরা পেঁয়াজ আমদানি না করার সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু ভোক্তারা এখন সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। তাই আমদানির অনুমতি দিলে দাম কমে যাবে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করার কারণেও সয়াবিন ও চিনির দাম বেশি বলে তিনি জানান।
চড়া সবজির বাজার
গত কিছুদিন ধরেই সবজির বাজারও চড়া। প্রায় সবসময়ই আলুর দামটা থাকে ক্রেতাদের কাছে সহনীয়। কিন্তু এবার আলুর দামও বেশ চড়া। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয় ৪০ টাকায়। এক মাস আগে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ২৮ থেকে ৩০ টাকায়। আরেকটি তুলনামূলক কম দামের সবজি পেঁপের কেজিও এখন ৫০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য সবজি ৭০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।