সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন কিছু চুক্তি সম্পাদন করা এবং পাশাপাশি বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের ওপর নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানগুলো বিশ্ব খেলোয়াড় বা পরাশক্তিদের কাছে নিজেদের অবস্থান খোলাসা করা।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে প্রান্তিক অর্থনৈতিক পরিসেবা বৃদ্ধি সহ গ্রামকে পর্যায়ক্রমে নগরায়নের পথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সফলতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের করোনার সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ২০ লক্ষ মানুষ মারা যেতে পারে এমন একটি ধারনা পোষণ করলেও করোনায় মৃতের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম ছিল।
বর্তমানে প্রকৃত বার্ষিক গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ ভাগ ধরে রাখতে বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে। যেখানে উন্নত দেশগুলো ১ থেকে ১.৫ শতাংশের বেশি জিডিপির ধরে রাখতে তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। বর্তমানে ইউরোপ তথা ইংল্যান্ডে ১০%, চায়নায় ০.১%, ভারতে ৫.৬৬%, পাকিস্তানে ৩৬.৪%, শ্রীলঙ্কায় ৩৫.৩%, মায়ানমারে ১৯.৫৫%, যুক্তরাষ্ট্রে ৪.৯%, জাপানে ৩.২% এবং সর্বোপরি বাংলাদেশে ৯.৩৩% মুদ্রাস্ফীতি চলছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হলে মুদ্রাস্ফীতির হার অতিশীঘ্রই বাংলাদেশে ৫% নেমে আসবে। প্রধানমন্ত্রী ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দ্বিপাক্ষিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বেগবান করেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
অত্যধিক মুদ্রাস্ফীতি ও ডলার সংকটের কারণে শ্রীলংকা দেউলিয়া হওয়ার তকমা মেখেছে। পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট তুঙ্গে। দেশটিতে সেনাবাহিনীগণ আন্দোলনের সংকটে রক্তাক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হলেও, এই দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট পর্যায়ক্রমে মীমাংসার মাধ্যমে সমাধানের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শান্তি শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিকে ঢেলে সাজাতে সক্ষম হয়েছেন।
চীনের সঙ্গে পশ্চিমা শক্তি ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব পর্যায়ক্রমে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ও চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য বাংলাদেশের সাথে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিশ্বের দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক শক্তিগুলো বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে ঘিরে আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিশ্ব পরাশক্তির দৌড়ঝাঁপ চললেও কূটনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার বিকল্প খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পর বাংলাদেশের অর্থনীতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপ্রতিদ্বন্দ্বী দিকপালে পরিণত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাছাড়া বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে বিশ্ব পরাশক্তির মধ্যে যে বিভাজনের রাজনৈতিক শক্তি এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতায় যাওয়ার অশুভ কৌশল। বিশ্ব অর্থনীতিতে জীবন যাত্রার মানে নানা রকম পরিবর্তন আসলেও তা সহনীয় পর্যায়ে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশেই সফলতার দিগন্ত উন্মোচন করতে সমর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ উন্নয়নের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে সন্ত্রাস এবং দুর্নীতি রাজনীতি নয়। ফলে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক নীতি এবং সাম্প্রতিক সফর এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের নেতৃত্বের গতিশীলতাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক অকপটে স্বীকার করেছেন যে শেখ হাসিনাই হচ্ছে তার এবং তার পরিবারের অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মডেল।
বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে এবং তা যথাযথভাবে চালু করে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাছাড়া তিনি দেশে সার্বিক নিরাপত্তা এবং সামরিক শক্তি বাড়িয়ে ভূরাজনৈতিক অর্থনৈতিক নেতৃত্ব বিকাশে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। ফলে রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া শেখ হাসিনা ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা ইস্যুতে আপোষীর নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন।
২০১৮ সালে শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। এই নীতির ফলে বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্তরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। জাপানের সঙ্গে সম্প্রতি ভ্রমণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু যুগান্তকারী চুক্তিতে আবদ্ধ হন। দুই দেশের মধ্যে কৃষি, মেট্রোরেল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আপগ্রেডেশন, শীপ রিসাইক্লিং, কাস্টম মেটারস, ইন্টালেকচুয়াল প্রপার্টি, ডিফেন্স কপেরেশন আইসিটি এবং সাইবার সিকিউরিটি অপারেশন ইত্যাদি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
এগুলো জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। তাছাড়া চীনের মত পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে একটি বৈরী পরাশক্তিকে বাংলাদেশের অসহায় রাখার বাস্তবতা পশ্চিমা বিশ্বের সম্প্রসারণবাদী ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে স্থিতিশীল রাখতে সমর্থ হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক টেকনোলজি ব্যবহারের এবং পারমাণবিক শক্তি শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহারের কৌশল অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। তাছাড়া এশিয়ার নিরাপত্তাজনিত কৌশলগত রাজনীতিতে রাশিয়াকে বাংলাদেশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সফর অত্যন্ত সফল হয়েছে। এ সফরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২.২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি সম্পাদন করেছেন। এই চুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিল্ডিং প্রজেক্ট (আরআইভিইআর), বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (বিইএসটি), অ্যাকসেলারেটিং ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রেড কানেকটিভিটি ইন ইস্টার্ন সাউথ এশিয়া (এসিসিইএসএস) বাংলাদেশ ফেজ-১, ফার্স্ট বাংলাদেশ গ্রিন অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ডেভেলপমেন্ট (জিসিআরডি) প্রজেক্ট ইত্যাদি।
বিশ্ব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জটিল প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সম্প্রতি নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে শ্রীলংকার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময় শ্রীলংকা দেউলিয়া হয়ে গেলে, বাংলাদেশ এবং ভারত শ্রীলঙ্কাকে প্রত্যক্ষ সাহায্য দিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণের সমর্থ হয়েছেন। যার ফলে শ্রীলংকা বর্তমানে ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশ শ্রীলংকাকে ২০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা সাহায্য দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময় মেট্রোরেল উদ্বোধন করে বাংলাদেশ বিশ্ব মেট্রোপলিটন সিটির মর্যাদা অর্জন করেছে। তাছাড়া যানজট নিরসনে এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত দীর্ঘ উড়াল সেতু নির্মাণ করে, এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক জোন নির্মাণ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সম্প্রসারণ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে টেকসই এবং গতিশীল উন্নয়নের পথকে সম্প্রসারণ করবে।
বিশেষ করে উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক করিডোর বিনির্মাণে জাপানের সহযোগিতা বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে এক বা একাধিক গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণবাদী গতিশীলতাকে বিশ্ব দরবারে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষ করে ভারতের সাথে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের বিশ্ব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুকে স্থিতিশীল রাখতে সমর্থ হয়েছে।
তাছাড়া বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্পষ্ট অবস্থান বিরোধী দলের অযৌক্তিক এবং অগ্রণযোগ্য দাবিকে বিশ্ব কূটনৈতিক মহল এটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা নয় বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুকে আর জোরালো ভাবে সমর্থন করছে না। সম্প্রতি জাপান রাষ্ট্রদূতের এমন মন্তব্য এটি প্রমাণ করে। যদিও আগামী নির্বাচন বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হচ্ছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে গতিশীল নেতৃত্বের আসনে বসাতে হলে এবং এটি স্থিতিশীল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প বর্তমান অবস্থায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।
বিশেষ করে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক প্রজ্ঞায় বর্তমান সরকারের বহুমুখী সৃজনশীল গতিশীলতা বাংলাদেশের অন্য কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে সমন্বয় করা অত্যন্ত দুরূহ এবং এটি বিবেচনায় নিয়েই সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপান সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলে বিজ্ঞ মহল মনে করেন এবং আগামী নির্বাচনে যেকোনো রকম বিশৃঙ্খলা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের জোয়ারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এমন প্রত্যাশা বাংলাদেশের জনগণ এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দ করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন।
লেখক: ড. আব্দুল ওয়াদুদ, ফিকামলি তত্ত্বের জনক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রেসিডিয়াম সদস্য – বঙ্গবন্ধু পরিষদ, প্রধান পৃষ্ঠপোষক – বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞানের সমিতি।