বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কালজয়ী ইসলামি সংগীত রচনার জন্য বাংলা সাহিত্যাকাশে বিশালতর এক ধ্রুবতারা হিসেবে চির অম্লান হয়ে থাকবেন। কাজী নজরুল ইসলাম তার অমর কীর্তিমান ইসলামি সংগীতগুলো না লিখলে বাংলার ইসলামি সংস্কৃতি হাজার বছর পিছিয়ে থাকত।
শানিত কলমের ছেদনীতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তুলে ধরেছেন ইসলাম ধর্মের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে কুরআন ও হাদিসের আলোকে হাজার বছরের সেরা সব ইসলামি সংগীত, গজল, হামদ, নাত। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাওহিদ, রিসালাত, ঈদ, রমজান, শবে কদর, শবে বরাত, মিরাজ, মহররম, ইসলামি জাগরণী গান, সাহাবাগণের জীবনাদর্শ, মহিয়ান-মহীয়সী নারী-পুরুষের জীবনীসহ সব বিষয়ের সুন্দর উপস্থাপন একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। পবিত্র কুরআন মাজিদের ৭৫ নম্বর সুরা ‘আল-কিয়ামা’র ছোট্ট ছোট্ট ৪০টি আয়াতের ছায়াশ্রয়ে কবি লিখেছেন, ‘যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার, তুমি হবে কাজী।/ সেদিন তোমার দিদার আমি, পাব কি আল্লাহ জি?’
সুরা আল-কিয়ামার ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘উজুহুই ইয়াও মাইজিন না-দিয়াহ।’ (সেদিন অনেক মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে।) ‘ইলা রাব্বিহা না-জিরাহ।’ (তারা তার পালনকর্তা, আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকবে।)
অর্থাত্, কেয়ামতের দিন যারা আল্লাহকে দেখতে পাবেন, তারা বেহেস্তি। অথবা যারা বেহেশতের ফায়সালা পেয়ে যাবেন, তারা আল্লাহকে দেখতে পাবেন। কাজী নজরুল ইসলাম তার ঐ গানের দ্বিতীয় অন্তরার শেষে বেশ কায়দা করে লিখলেন, ‘আমি তোমায় দেখে হাজার বার, দোজখে যেতে রাজি!’ আহ! কী সুন্দর, সুললিত ভাষায়, আবেগাপ্লুত সুরে কবি আল্লার বাণীগুলো তার ইসলামি গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন!
কবরবাসীদের প্রতি দোয়া করার বিষয়ে অনেক হাদিস এসেছে। সেই হাদিসগুলোর আলোকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায়, কবর দিও ভাই,/ যেন গোরে থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’ মুসল্লি ঘর থেকে অজু করে মসজিদে যাওয়া পর্যন্ত তার প্রতিটি কদমে সওয়াব লেখা হয়। এই হাদিসের আলোকে কবি ঐ গানের দ্বিতীয় অন্তরায় লিখলেন, ‘আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজিরা যাবে,/ পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি, এই বান্দা শুনতে পাবে।/ গোর আজাব থেকে এই গুনাহগার, পাইবে রেহাই।’
কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের অনুরোধে ইসলামি সংগীতের ধূমকেতু হয়ে আর্বিভূত হয়েছিলেন বাংলার ইসলামি সংস্কৃতির সাহিত্যাকাশে।
১৯৩১ সালে তার লেখা, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ।’ গানটা উপমহাদেশের প্রতিটা মানুষের হূদয় স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছিল। রমজান মাসের ৩০টা রোজার শেষে সাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ দেখে ঐ গানটা শুনলে নিজেকে পূতপবিত্র মনে হয়।
মাত্র আট বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর দুবেলা দুমুঠো অন্নের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম হয়েছিলেন মসজিদের মুয়াজ্জিন এবং মক্তবের ওস্তাদ। যুবক বয়সে যোগ দিয়েছিলেন লেটো দলে। তখনই তিনি লিখেছিলেন, ‘নামাজি, তোর নামাজ হলো রে ভুল’। আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, বাংলার পাণ্ডিত্বপূর্ণ ভাষাশৈলী প্রয়োগের মাধ্যমে এবং হূদয় শীতল করা ভাবাবেগী সুরের মূর্ছনায় ইসলামি সংগীতগুলোকে তিনি করেছেন চির অম্লান, চিরসবুজ, চির অপ্রতিদ্বন্দ্বী, চির অমর। সিদ্ধহস্তে বিদেশি ভাষার সুন্দর প্রয়োগের পাণ্ডিত্যে, কখনো বিদেশি সুরের ছায়াশ্রয়ে তিনি ইসলামি সংগীতকে করেছেন বাঙালি হূদয়ের তৃষ্ণা নিবারণের শরাবসম। তুরস্কের বিখ্যাত, ‘কাটিবিম ইশকাদার’ গানের সুরাশ্রয়ে কবি লিখলেন, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ, এলো রে দুনিয়ায়’ অথবা ‘শুকনো পাতার নূপুর বাজে, নাচিছে ঘূর্ণিবায়’ ইত্যাদি।
শিশু নবি হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর ধরণিতে আগমন নিয়ে হূদয়ের গভীর থেকে আবেগী হয়ে কবি লিখলেন, “হেরা হ’তে হেলে দুলে, নুরানী তনুর—” অথবা “তোরা দেখে যা, আমিনা মায়ের কোলে” অথবা “আমিনা দুলাল নাচে, হালিমার কোলে” ইত্যাদি ইত্যাদি।
দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হজে যাওয়ার আকুতি ফুটিয়ে তুলেছেন তার অনেক অমর কীর্তিতে। তার লেখা ‘দূর আরবের স্বপন দেখি, বাংলাদেশের কুটির হতে!’ কিংবা ‘মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়’ বা ‘ওরে ও দরিয়ার মাঝি, মোরে নিয়ে যারে, মদিনায়’ অথবা ‘আমি যদি আরব হতাম, মদিনারই পথ’সহ বহু গানের কথাগুলোয় পবিত্র মক্কা ও মদিনায় যাওয়ার পরম আকুতি প্রকাশ পেয়েছে।
মোনাজাত বিষয়ে তিনি লিখলেন, ‘হে খোদা দয়াময় রহমানির রহিম’ অথবা ‘খোদা, এই গরিবের শোন মোনাজাত’ অথবা ‘শোনো শোনো, ইয়া ইলাহী, আমার মোনাজাত’ ইত্যাদি। এই মহাপুরুষ কাজী নজরুল ইসলামকে আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান,
হলি ক্রিসেন্ট ফাউন্ডেশন