শুক্রবার, ০২ জুন ২০২৩, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

দেশি ফলেই বাজার মাত!

মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ, বছরে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে উৎপাদন বাড়ছে, চাষ হচ্ছে ৭২ প্রজাতির, তবে চাষের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক ফল

আপডেট : ২৭ মে ২০২৩, ০৮:০০

বিদেশি ফলকে হটিয়ে এখন দেশের বাজার দখল করে রেখেছে দেশি ফল। শীতকাল ছাড়া বছরের বাকি সময়টা দেশি ফলের দখলেই থাকে বাজার। এর মধ্যে বিদেশি ফল এলেও তা দেশি ফলের বাজার সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ—এই দুই মাস গরমকাল। ফলের বিবেচনায় এই দুই মাসকে বলা হয় মধুঋতু, আর জ্যৈষ্ঠ মাস হলো মধুমাস। আম, জাম, লিচু, কাঁঠালে জমজমাট ফলের বাজার। তবে শুধু এসব ফলেই থেমে নেই গরমের ফলের তালিকা। এখন আরও অনেক ফল চাষ হচ্ছে। মানুষের কাছে সেসব ফলের চাহিদাও বাড়ছে দিনদিন।

ফল আমদানিকারকরা বলছেন, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় বিদেশি ফলের চাহিদা নেমে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে। এ সময়টায় বাজারের ৮০ শতাংশ ফলের চাহিদা পূরণ করে দেশি ফল। মৌসুমি ফলের দাপটে এ সময় বিদেশি ফল আমদানি কমে যায়। তবে এতে খুশি হওয়ার মতো কিছু হয়নি।  অদূর ভবিষ্যতে বিদেশি ফলের বাজার হটিয়ে দেশি ফলের বাজার দখল সম্ভব হবে না। এর কারণ হিসেবে ফল ব্যবসায়ীরা জানালেন, দেশি ফলের বাগান খুব বেশি নেই। বাণিজ্যিকভাবে চাষ না বাড়লে দেশি ফলের বাজার সম্প্রসারণ করা সহজ হবে না।

কৃষিবিদ ও গবেষক মৃত্যুঞ্জয় রায় জানান, বনভূমি কমে যেতে থাকায় অনেক ফলই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে বাঙ্গি, তরমুজ, কলা, পেয়ারা, কুল, আম, আনারস ছাড়া আর কোনো ফলের দেখা হয়তো সহজে মিলবে না। যেমন এখন বেতফল নজরেই পড়ে না, দেখা যায় রসালো শাঁসের ভুতিজাম আর পুঁতি দানার মতো বুটিজামকে, তেমনি হয়তো কদিন পরেই আর দেখাই যাবে না লুকলুকি, মাখনা, কাউয়াডুলি, পানিজাম, পানকি চুনকি, আইকা গোটা, হামজাম ও ডেউয়াকে। এক আমলকীর মধ্যে লুকিয়ে আছে পাঁচ কমলার ভিটামিন সি, অথচ সেই আমলকীকে হেলা করে কোলে তুলে নিচ্ছি কমলাকে।

এদিকে  ফল উৎপাদন দিনদিন বাড়ছে—দাবি করে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, বছরে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। তিনি বলেন, মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, পেঁপেতে ১৪তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। নিত্যনতুন ফল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে। ২০ বছর আগে আম আর কাঁঠাল ছিল এ দেশের প্রধান ফল। এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত সাত বছরের ব্যবধানে দেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২২ লাখ কেজি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশি ফল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯৯ লাখ ৭২ হাজার কেজি। আর ২০২২ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ কেজিতে। দেশি ফলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে—এতে রাসায়নিকের ব্যবহার হয় খুব কম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই হয় না। তাই নিশ্চিন্তে খাওয়া যায় এসব ফল।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের দপ্তর সম্পাদক রাকিব হোসেন জানান, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বিদেশি ফল আমদানির পরিমাণ কমে আসে। এ সময়টায় দেশি ফলই বাজার দখল করে রাখে। এ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ মো. আসাদুল্লাহ বলেন, অন্যান্য দানাদার খাদ্যশস্য অপেক্ষা দেশি ফলের গড় ফলন অনেক বেশি। ফলের মূল্য বেশি হওয়ায় তুলনামূলক হারে আয়ও অনেক বেশি। যেমন—এক হেক্টর জমিতে ধান-গম চাষে আয় হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অথচ সমপরিমাণ জমিতে কলা ও আম চাষ করে যথাক্রমে আয় হয় ৭৫ হাজার ও ১ লাখ টাকা। জাতীয় অর্থনীতিতে তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ফল ও ফলদ বৃক্ষের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য কৃষকদের ফল উৎপাদনে সঠিক প্রশিক্ষণ ও তথ্য সরবরাহ করতে পারলে দেশে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

গ্রীষ্ম বলা হলেও আসলে এ মৌসুমে উৎপাদিত অনেক ফলের বিস্তৃতি থাকে বর্ষাকাল পর্যন্ত। নাবি জাতের আম বর্ষা ঋতু এমনকি ভাদ্র মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। অথচ আম গ্রীষ্মকালের প্রধান ফল। এ দেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপাদন হয় বৈশাখ থেকে শ্রাবণের মধ্যে অর্থাৎ চার মাসে। বাকি ৪০ শতাংশ ফল উৎপাদিত হয় বাকি আট মাসে। এজন্য গ্রীষ্ম মৌসুমকে বলা হয় ফলের মাস। গ্রীষ্মকালে এ দেশে পেয়ারা, পেঁপে, কলা, নারিকেল, সফেদা, তালশাঁস, লেবু, আম, কামরাঙা, ড্রাগন ফল, ডেউয়া, জাম, কাঁঠাল, তৈকর, প্যাশন, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, বাঙ্গি, চুকুর, লিচু, আঁশফল, তরমুজ, ফলসা, করমচা, গাব, হামজাম, বৈঁচি, লুকলুকি, জামরুল, গাব, বেতফল, মুড়মুড়ি, খেজুর, ননিফল, আতা, শরিফা ইত্যাদি ফল পাওয়া যায়। ফলের মাসে এ পল্লিবাংলার ঘরে ঘরে বসে নানা রকম ফলাহারের আয়োজন। জ্যৈষ্ঠ মাসে হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের জামাই ষষ্ঠী অনুষ্ঠান, যে অনুষ্ঠানের প্রধান উপকরণ নানা রকমের প্রচুর ফল। গ্রামের হিন্দু নারীরা বৈশাখ মাস জুড়ে নানা রকম ব্রত পালন করেন। এসব ব্রতের অন্যতম অনুষঙ্গ নানা রকম ফল।

বাংলাদেশের ফল :আম, কলা, ফলসা, কাঁঠাল, বেল, আমলকী, পাতিলেবু ইত্যাদি ফলকেই বিজ্ঞানীরা এ দেশের ফল বলে মনে করেন। লিচু, গাব, পিচ, আঁশফল, কমলা এসেছে চীন থেকে। পেয়ারা, পেঁপে, আতা, আনারস, সফেদা, ডালিম ইত্যাদি ফলের আদিনিবাস আমেরিকা। কিন্তু এগুলো এ দেশে এত দীর্ঘদিন ধরে জন্মাচ্ছে যে, তা এখন আমাদের দেশি ফলে রূপান্তরিত হয়েছে। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ভারতবর্ষে এসেছিলেন ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এ দেশে ঘুরে তার ভ্রমণবৃত্তান্তে এ দেশে আম, ডালিম, কলা, কুল, আমলকী, কাঁঠাল, গাব, কতবেল, কমলা ইত্যাদি ফল দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন। তার মানে সুদূর অতীতে কোনো কোনো ফল এ দেশে এলেও সেগুলো এখন আমাদের দেশি ফলে পরিণত হয়েছে। এ ধারা অনন্তকাল ধরে অব্যাহত থাকবে। কেননা বিগত দশকেই এ দেশে বিদেশ থেকে আসা ও চাষ হওয়া প্রায় ৩০টি ফলকে ইতিমধ্যেই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় জানান, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৩০টি ফলকে দেশি ফল হিসেবে শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে ৬০টি বুনো ফল। বাংলাদেশের প্রধান ফল ১০টি, বর্তমানে বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ ফলের সংখ্যা ১৮টি। প্রধান ফলগুলো হলো আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, কলা, কুল, নারিকেল, লেবু, আনারস, পেঁপে, বাঙ্গি ও তরমুজ। বাকি সব অপ্রচলিত বা অপ্রধান ফল। অপ্রধান ফলের মধ্যে অন্যতম হলো জাম, গোলাপ জাম, জামরুল, তেঁতুল, কতবেল, বেল, সফেদা, কামরাঙা, লুকিলুকি, আঁশফল ইত্যাদি।

দেশি ফলের মধ্যে অনেক ফলের আবার অনেকগুলো জাতও এ দেশে রয়েছে। এজন্য প্রথমেই দরকার দ্রুত নানা রকম ফলের ও তাদের জাতসমূহের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। এক তথ্য সূত্রে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ১০১টি আমের জাত, ছয়টি লিচুর জাত, ২১টি বরই ও কুলের জাত, ২৫টি কলার জাত এবং একটি করে জামরুল ও ডালিমের জাত সংগৃহীত হয়েছে। বেশ কিছু আধুনিক ও উচ্চফলা জাত এর মধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে। হরেক রকমের লেবু আছে আমাদের দেশে। অন্তত ৫০ রকমের লেবু শুধু সিলেট অঞ্চলেই আছে। লেবুর মতোই অন্যান্য ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করতে হলে সেসব ফলের সম্ভাব্য উৎপাদন এলাকা সম্পর্কেও একটা ধারণা থাকা দরকার। যেমন—আম ভালো হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে, লেবু হয় সিলেটে, আনারস হয় মধুপুর ও সিলেটে, কাঁঠাল হয় গাজীপুরের শ্রীপুরে, কাউফল হয় বাগেরহাটে, সফেদা হয় সাতক্ষীরা ও খুলনায়, পেয়ারা হয় পিরোজপুরে ইত্যাদি। তবে এ ফলগুলোর অধিকাংশই এখন বিপন্ন। বসতবাড়িতে দু-একটি গাছ রয়েছে, বনে জঙ্গলেও কিছু আছে। কিন্তু ব্যাপক হারে এসব ফলের গাছ চোখে পড়ে না।

ইত্তেফাক/এমএএম