বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা দাবির ঘটনা বেড়েই চলেছে। ইতিমধ্যে এসব ঘটনার নিরাপত্তা চেয়ে বেশ কয়েকটি থানায় ভুক্তভোগীরা জিডিও করেছেন। এমনকি শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ফোন করে তাদের নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ফ্ল্যাট লিখে দেওয়ারও হুমকি দিচ্ছে। যদি ফ্ল্যাট লিখে না দেয়, সেক্ষেত্রে সমপরিমাণ অর্থ অবস্থাভেদে ১ কোটি টাকা থেকে ২ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করছে।
পুলিশ বলছে, এলাকার ছিঁচকে সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে চাঁদা দাবি করছে। ১০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে অবস্থাভেদে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। পরে স্থানীয় চিহ্নিত বখাটে গ্রুপের মধ্যস্থতায় ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় দফারফা করা হচ্ছে। তবে থানায় জিডি করলেও ভুক্তভোগীরা গোপনে স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে চাঁদার টাকা তুলে দিচ্ছে।
রাজধানীর মতিঝিল, রমনা, বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, শাজাহানপুর, আদাবর, মহাখালী ও পল্লবী এলাকায় বিদেশে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে চাঁদা দাবি করার ঘটনা ঘটছে। দুই-একটি ঘটনা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার মধ্যস্থতায় সমাধানও করা হচ্ছে।
এসব ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন শাখার উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, আজ থেকে ২২ বছর আগের এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। কেউবা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। কেউবা বিদেশ পালিয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসীর অবস্থান নেই। এক শ্রেণির ছিঁচকে চোর ছ্যাচ্চর শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে কাউকে কাউকে ফোন করে চাঁদা দাবি করছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা বা জিডি করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অ্যাকশন নিচ্ছে। ইতিমধ্যে এ ধরনের ছিঁচকে সন্ত্রাসী গ্রুপ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
গত ১১ মে রমনা থানায় এক ব্যক্তি জিডি করেন। জিডির একস্থানে বলা হয়েছে, ‘সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী আমার কাছে দুইটি ফ্ল্যাট চেয়েছে। এরপর থেকে বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে কল করে সুব্রত বাইন পরিচয় দিয়ে আমাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। আমি যদি সুব্রত বাইনের পাঠানো ব্যক্তির কাছে ফ্ল্যাট না লিখে দিই, তাহলে সুব্রত বাইন আমাকে প্রাণে মেরে ফেলবে।’
এ বিষয়ে পুলিশের রমনা বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, জিডি হওয়ার পরপরই আমরা তদন্তে নামি। সুব্রত বাইনের নাম ব্যবহার করে এলাকার এক ছিঁচকে সন্ত্রাসী ঐ ব্যক্তির কাছে ফ্ল্যাট লিখে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। ঐ ছিঁচকে সন্ত্রাসী একবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারও হয়েছিল। জিডি হওয়ার পর সে পলাতক রয়েছে। আমরা তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।
র্যাব সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, সুব্রত বাইনের নামে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চাঁদাবাজি হয়। এর মধ্যে মালিবাগ, মগবাজার ও খিলগাঁও এলাকায় বেশি। ২০১৫ সালে সুব্রত বাইন নেপাল কারাগার ভেঙে ভারতে আত্মগোপন করে। ঐ বছরে সুব্রত বাইন কলকাতায় গ্রেফতার হয়। বর্তমানে সুব্রত বাইন কলকাতার আলীগড় জেলখানায় বন্দি। জেলখানা থেকেই মাঝেমধ্যে ঢাকায় ফোন দেয় সে। তবে মগবাজার এলাকায় তার একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। ঐ সিন্ডিকেটের দুই/তিন জন সন্ত্রাসী ইতিমধ্যে র্যাবের হাতে গ্রেফতারও হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই। আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জের ধরে দুবাই থেকে পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল শাখার মাধ্যমে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী মুসাকে আটক করে দেশে ফেরত এনেছি। সুব্রত বাইনের নামেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগ আমরা তদন্ত করছি। এছাড়া অন্যান্য যেসব সন্ত্রাসীর নামে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে, সেসব ঘটনা তদন্ত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে র্যাব।
অপরদিকে, জেলখানায় বসেই মিরপুরের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম কিলার আব্বাস। নিয়ন্ত্রণ করছে গার্মেন্টসের জুট ব্যবসা, ডিস ব্যবসা, টেন্ডার, মাদক ব্যবসা। করছে চাঁদাবাজি ও অপরের বাড়ি দখলসহ নানা অপকর্ম। দীর্ঘদিন জেলে বন্দি থাকলেও এখনো ইব্রাহিমপুর, কাফরুল ও ভাসানটেকসহ আশপাশের বাসিন্দারা কিলার আব্বাস বলতেই আঁতকে ওঠেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি হেলেনা নামের এক নারীকে মারধরের পর বিবস্ত্র করে আব্বাস বাহিনীর নারী সদস্য রাশিদা ও তার ছেলে রাজিব একটি গার্মেন্ট থেকে বের করে দেয়। ভুক্তভোগী হেলেনা বাদী হয়ে আদালতে এ ঘটনায় মামলাও করেন। কিলার আব্বাসের নির্দেশে জিল্লুর, মাহমুদা এবং রহমান এলাকার অপকর্মের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। মাহমুদা, মুন্না চিশতী, ওটো ফরিদ, বিয়াই শহীদ, ইমন, লিখন, বাপ্পি, টুটুল, সুমন, রাজিব, চন্দ্রা, আলমগীর, কাসেম, কালা ইব্রাহিম, জাউরা মামুন, শফিকুর রহমান ওরফে মঞ্জু এলাহীর বাইরে কেউ কোনো গার্মেন্টস থেকে মালামাল ক্রয় করতে পারে না। কিলার আব্বাস বাহিনী কিছু দিন আগে মিরপুর-১০ নম্বরের ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে তার পরিবারের লোকজন ৯৯৯ লাইনে ফোন করলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। সন্ত্রাসীরা গিয়াসের কাছে ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। এ ব্যাপারে গিয়াসের পরিবারের পক্ষ থেকে মিরপুর থানায় জিডি করেছেন। একইভাবে ব্যবসায়ী রনজু, রুস্তুম আলী সরদার, ছিদ্দিক এবং মান্নানসহ অসংখ্য ব্যবসায়ী আব্বাস বাহিনীর নির্যাতন নিপীড়নের শিকার।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ইতিমধ্যেই ভয়ংকর সন্ত্রাসীরা কে কোথায় আছে খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। অনেকে জেলে থাকা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। তবে পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে অনেকগুলো উঠতি সন্ত্রাসী গ্রুপ। এরাই বিদেশে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে এলাকায় ভয়-ভীতি প্রদর্শন করছে। এসব উঠতি মাস্তান বাহিনীর একটি তালিকাও করা হচ্ছে।