মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

তেঁতুলিয়ায় চা বাগান কেটে ফেলছেন চাষিরা

আপডেট : ২৮ মে ২০২৩, ২০:২৩

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সমতল ভূমিতে চা শিল্পে নিরব বিপ্লব ঘটেছিল। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চা শিল্পের এমন বিপ্লবে বর্তমানে চা উৎপাদনের রেকর্ড ঘটেছে এ অঞ্চল। 

চা উৎপাদনকারী দেশের তৃতীয় বৃহত্তম অঞ্চল হিসেবেও স্থান করে নিয়েছে। উৎপাদনের রেকর্ড গড়লেও চরম হতাশা তৈরি করেছে চাষিদের। এক শ্রেণির অসাধু ও কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে কাঁচা চা পাতার দাম পাচ্ছেন না তারা। 

চা বাগান কেটে ফেলছেন চাষিরা। ছবি: ইত্তেফাক

চাষিদের অভিযোগ, চা বাগান ঘিরে কারখানা বাড়লেও বাড়ছে না চা পাতার দাম। চা শিল্প ঘিরে তৈরি হয়েছে এক ধরনের সিন্ডিকেট। কয়েক বছর ধরেই পাচ্ছেন না উৎপাদিত কাঁচা চা পাতার ন্যায্য দাম। চলতি মৌসুমে চা পাতা কারখানাগুলো যে দামে কিনছে, তাতে করে তাদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। বছরের শুরুতেই গুনতে হচ্ছে লোকসান।  

আগে কেজি প্রতি চা পাতার দাম পেতেন ৩০-৪০ টাকা। এখন কারখানার মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে সরকার নির্ধারিত ১৮ টাকাও পাচ্ছেন না চা পাতার দাম। প্রতি কেজি চা পাতা উৎপাদনে খরচ হয় ১৫ থেকে ১৬ টাকা। আর সেই চা পাতা কারখানায় নিয়ে বিক্রি করে উৎপাদন খরচও আসছে না তাদের। দিনের পর দিন কিছু অসাধু ব্যক্তিদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে লোকসান গুনছেন সমতলের ৭ হাজারের বেশি চা চাষি। যারা ঋণ করে চায়ে বিনিয়োগ করেছিলেন লোকসান গুনতে গুনতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। অনেকে ক্ষোভে তাদের স্বপ্নের বাগান কেটে ফেলছেন।

চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিকভাবে চা শিল্পের শুরু হয়। গত দুই দশকে বদলে যায় প্রেক্ষাপট। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি হয়ে উঠে সবুজ চা বাগান। সবুজ পাতায় জেগে উঠে নতুন অর্থনীতি। চা উৎপাদনে সিলেটের পর দ্বিতীয় অঞ্চল হয়ে উঠেছে এ জেলা। প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে সাত হাজার চা-বাগান। গত বছর শুধু এ অঞ্চলে এক কোটি ৫২ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ জড়িয়ে পড়েছেন চা শিল্পে। বেকারদের একটি বড় অংশ চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে চা চাষে বিনিয়োগ করেছেন। বর্তমানে জেলায় ২৩টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা চালু রয়েছে।

চা বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তরাঞ্চলের উৎপাদিত চায়ের মান খুবই উন্নত, যা দার্জিলিং ভ্যারাইটির মতো। অথচ নিম্নমানের তৈরি চা নিলামে তুলে নিলাম মূল্য অনুযায়ী প্রতিবছর কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের চাষিরা লাভের পরিবর্তে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

উপজেলার শারিয়ালজোত গ্রামের ক্ষুদ্র চা চাষি সাঈদ বলেন, লাভবান হতে এক বিঘা জমিতে চা আবাদ করেছিলাম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনতে গুনতে আর পারছি না। চা পাতার দাম নেই। বাজারে চাল-ডাল বাকি নিতে গেলেও দোকানদাররা বাকি দিতে চান না। 

আরেক চা চাষি নিজাম বলেন, সরকারিভাবে চা পাতার দাম ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও কারখানাগুলো ১৩-১৫ টাকা কেজি দরে পাতা কিনছেন। তার মধ্যে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সেখান থেকে ৩০-৫০% পর্যন্ত পাতা কেটে নিচ্ছেন। ১০০ কেজি পাতা কারখানা নিলে ৫০ কেজি কেটে নিচ্ছে। বাকি ৫০ কেজির দামও পাচ্ছি কম। ঘর থেকে আর কতো লোকসান গুনব। সার-কীটনাশক, শ্রমিক খরচও উঠছে না। তাই চা আবাদ বাদ দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। 

তেঁতুলিয়ার বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরি লিমিটেডের পরিচালক সাইদুর রহমান মিয়া বলেন, চাষিরা যে সিন্ডিকেটের কথা বলছেন তা ঠিক নয়। মূলত তারা কারখানায় ভালো মানের পাতা দিতে পারছেন না। আর এবারের প্রকৃতি অনুকূল না থাকায় খরার কারণে অনেক কৃষকের চা পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে ভালো পাতা পাচ্ছি না। এখানে আমরাও নিরুপায়, ভালো পাতা না পেলে ভালো প্রডাকশন কীভাবে করব। নিলাম বাজারে যদি দাম না পাই তাহলে চাষিদের কীভাবে ভালো দাম দিতে পারি। এক্ষেত্রে চাষিরা যদি তাদের বাগানে কাঁচি দিয়ে নয়, মেশিনের সাহায্যে পাতা তুলতে পারেন তাহলে তারা দাম পাবেন। 

গ্রিন কেয়ার এগ্রো লিমিটেডের চা কারখানার ম্যানেজার মঞ্জুরুল আলম বলেন, চট্টগ্রামের নিলাম মার্কেটে সিলেটের তৈরি চায়ের তুলনায় আমাদের চায়ের দাম কম। কারণ তারা যে নিয়ম মেনে বাগান থেকে চা উত্তোলন করে, আমরা সেই নিয়মের ধারেকাছেও নেই। এখানকার ক্ষুদ্র চা চাষিরা হাতের বদলে কাঁচি দিয়ে আট থেকে ১০ পাতা পর্যন্ত ডালসহ কেটে কারখানায় নিয়ে আসেন। অথচ নির্ধারণ করা আছে চার থেকে সাড়ে চার পাতা পর্যন্ত। এ কারণে আমরাও চায়ের মান ঠিক রাখতে পারছি না। যার কারণে আমাদের চায়ের চাহিদা কমে যায়। চাহিদা কমে গেলে দামও কমে যায়। তাই চা চাষিরা ভালো মানের পাতা সরবরাহ করলে মূল্য নির্ধারণ কমিটির দর অনুযায়ী কাঁচাপাতা কিনব। সেক্ষেত্রে আমরাও ভালো মানের চা উৎপাদন করতে পারব এবং নিলাম মার্কেটে আমাদের চায়ের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে।

চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, বর্তমানে সমস্যাটা দুদিকেই। কারখানা মালিকরা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে খেয়াল-খুশি মতো চা পাতা কিনছেন। আর চাষিরাও পাতা তোলার সময় নিয়ম মানছেন না। তারা ৭-৮ পাতা পর্যন্ত বাগান থেকে পাতা তুলে কারখানা নিয়ে যাচ্ছেন। আগামী মাসে দেশের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্র চালু হচ্ছে এ জেলায়। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। নিলাম কেন্দ্র চালু হলেও চাষিরা উপকৃত হবেন।

ইত্তেফাক/এবি/পিও