শীতের ঘন কুয়াশা কাটিয়ে বাংলাদেশ বিমানের বিশাল এয়ারক্রাফটটি যখন লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে, ঘড়ির কাঁটায় সম্ভবত তখন সকাল সাড়ে ছ’টা। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। ১৯৮৭ সাল। প্রচণ্ড শীত। কিন্তু আমাদের মনে তখন ব্রিটেনের রাজধানীতে প্রথম আন্তর্জাতিক নজরুল উত্সবে অংশ নেবার এক উষ্ণ অনুভূতি কাজ করছিল। সরকারি পর্যায়ে উদযাপনের এই অভিনব, গুরুত্বপূর্ণ, স্মৃতিবহ ও ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার পরিকল্পনা সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়, নজরুল ইন্সটিটিউট ও শিল্পকলা একাডেমি যৌথভাবে করেছিল।
এই অনুষ্ঠান ঘিরে মাসব্যাপী চলে আমাদের গান বাছাই, প্রশিক্ষণ, রেকর্ডিং। লন্ডনেও ব্যাপক প্রচারের ফলে অনুষ্ঠানে প্রায় প্রতি পর্বে উপচে পড়া ভিড় আর লোক সমাগম হয় বিপুলসংখ্যক। ঢাকা থেকে গোটা আয়োজনের নেতৃত্বে ছিলেন নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। সংগীতশিল্পী হিসেবে খালিদ হোসেন, আমি আর ফাতেমা তুজ জোহরা। শিল্পকলা একাডেমি থেকে সংগীতগুণী ওমর ফারুকের নেতৃত্বে অংশ নেন শুক্লা সরকার, শামীম আরা নিপা, শিবলী মোহাম্মদ, তামান্না রহমানসহ একটা বড় নাচের দল। সঙ্গে ছিল দক্ষ যন্ত্রীদল। এছাড়াও লন্ডনে তখন অবস্থানরত শিক্ষক ও কিংবদন্তি শিল্পী শেখ লুতফর রহমান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীসহ আরো বহু গুণী লোকের অংশগ্রহণে এক বর্ণাঢ্য আয়োজন হয়। সংগীত রজনী, আলোচনা, কবির দুষ্প্রাপ্য ছবি প্রদর্শনী, নজরুলের নারী বিষয়ক ভাবনাসহ সেমিনার, কবিতা আবৃত্তি, নাটক আর আমাদের নজরুলের বিভিন্ন ধারায় গান নিয়ে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী এ অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করে ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশন।
বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, বেতার, গ্রামাফোন-এর চিফ ট্রেনার, চলচ্চিত্র ও সর্বোপরি সংগীতে ক্ষণজন্মা নজরুলের প্রতিভার স্পর্শে হয়েছে উজ্জ্বল। বাঙালির জীবনে ছিল তাঁর দিগন্ত বিস্তৃত প্রভাব। তাঁর সৃষ্টিশীল জীবন যদিও মাত্র ২২ বছরের, আর তার মূল অংশজুড়েই যেন সংগীত। এই সুর ও সংগীত যেন হারিয়ে না যায়, যেন অগণিত শ্রোতা তার আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়, সে উদ্দেশ্যেই দেশের বাইরে নজরুল উত্সবের আয়োজন হয় এবং এটা প্রতিবছর হওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে এই আকারের অনুষ্ঠান আর আয়োজিত হয়নি এমনকি তাঁকে নিয়ে আজো কোনো ডকুমেন্টারি নেই, সেই অর্থে।
এখনকার নবীন শিল্পী যারা নজরুল ইন্সটিটিউট বা নজরুলচর্চার সঙ্গে যুক্ত তারা হয়তো বহু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের অভাবে অনেক ইতিহাস সম্বন্ধে অবহিত নয়। বহু কালজয়ী কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, এমনকি সমজদার শ্রোতা এই প্রতিষ্ঠানকে স্বমহিমায় গড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমরা যারা জড়িত তারা দেখে অভ্যস্ত যে, যে কোনো অনুষ্ঠানে নজরুল ভক্ত আর বিশারদে পরিপূর্ণ থাকত কবিভবন। সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে চোখে পড়ত ইন্সটিটিউটের বড় ঘরে, কখনো খোলা বারান্দায় দোতলায় বড় টেবিলে হারমোনিয়ামের সামনে সুধীনদা অথবা শেখ লুতফর রহমান স্যার আর তাঁদের ঘিরে নজরুলসংগীত স্বরলিপি প্রমাণিকরণ বোর্ড—দিনের পর দিন কাজ করছেন প্রায় সকল কিংবদন্তি শিল্পী। শ্রদ্ধেয় লায়লা আরজুমান্দ বানু, শেখ লুতফর রহমান, ফিরোজা বেগম, সোহরাব হোসেন, সুধীন দাস, বেদারউদ্দিন আহমদ, আহসান মুর্শেদ, ফেরদৌসী রহমানসহ বহু বড় মাপের শিল্পীরা বসে এক একটি গান গ্রামাফোনে বাজিয়ে তা আদি সুর ও কথা অ্যাপ্রুভ করতেন। প্রায় সময় ঝগড়া লেগে যেত, অনেকে সুর বা বাণী নিয়ে ‘দ্বিমত’ প্রকাশ করতেন। পরিশেষে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আদি সুরে স্বরলিপি প্রকাশিত হতো। সবার মধ্যেই নজরুলকে সঠিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টায় কোনো খাদ ছিল না। দেখেছি শ্রী সুধীন দাসকে দিনের পর দিন ঘষা পুরনো রেকর্ড কানের কাছে বাজিয়ে তার থেকে আদি সুরটা বের করে স্বরলিপি প্রকাশ করতে। তাতে করে একসময় তাঁর চোখ আর কান দুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবু এ গুরুদায়িত্ব থেকে তাঁরা কেউ পিছপা হননি। একের পর এক আদি সুরে আমরা স্বরলিপি পেয়েছি কবির হারিয়ে যাওয়া গানের।
এরই মাঝে আমাদের প্রশিক্ষণ ক্লাস চলত কখনো বিশাল অডিটোরিয়ামে অথবা নির্ধারিত ক্লাসরুমে। যে কোনো বড় আয়োজন অথবা কবির জন্মদিনে আসতেন ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, আসতেন গবেষক ও সংগ্রাহক আসাদুল হক, করুণাময় গোস্বামীসহ নজরুল বিশেষজ্ঞ ও গুণীজনরা। আগ্রহ ভরে আসতেন সংস্কৃতি মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের অনেকেই।
আমার স্কুলজীবন থেকেই ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনে সংগীতচর্চার দুয়ার খুলে যায়। আমার আরো সৌভাগ্য হয়, জাতীয় কবিকে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে অংশ নেওয়ার। আমেরিকার প্রথম ‘নর্থ আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স’ ১৯৯০ সালে নিউজার্সিতে অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন করেন কিংবদন্তি শিল্পী ফিরোজা বেগম। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে এই সময় তিন মাসব্যাপী অগণিত কনসার্টে অংশ নিই আর দেখার সুযোগ হয় এই কিংবদন্তি শিল্পীর পরিবেশনাসহ আমেরিকায় নজরুলের গানের ব্যাপক চাহিদা। হারওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, নিউইয়র্ক, বস্টন-এর এমআইটিসহ ওয়াশিংটন ডিসি, পিটসবার্গ—সব জায়গায় শ্রোতাদের উপচে পড়া ভিড়। সৌভাগ্য হয় ভারতের কিংবদন্তি শিল্পী দীপালি নাগ চৌধুরীর আয়োজনে একক কনসার্ট করার। ভারতে বাংলাদেশের প্রথম হাই কমিশনার তখন আমার শ্বশুর ড. এ আর মল্লিক। ভারতের দূরদর্শনে সে সময় ১৯৭৪ সালে ঠুমরী কুইন নায়না দেবীর প্রযোজনায় নজরুলের পাঁচটি গান রেকর্ড করি—যা প্রায়শই প্রচারিত হতো। এছাড়াও ১৯৯২-এ ফিরোজা বেগমের পরিচালনায় আমার বারোটি একক গানের সিডি অ্যালবাম প্রকাশ করে এইচএমভি—‘এলো ফুলের মরসুম’ শিরোনামে। নজরুলকে নিয়ে ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল ফোর একটা দুর্লভ ডকুমেন্টারি করে। এখানে ফিরোজা বেগম, ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের সঙ্গে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ১৯৮৪-এ আমারও দুটো গান রেকর্ড করা হয়, যার একটি ইসলামি অপরটি কীর্তন। বক্তব্য রাখেন নজরুল অধ্যাপক এমিরেটস প্রফেসর রফিকুল ইসলাম ও নজরুল বিশারদ ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। সেই ডকুমেন্টারি ড. রফিকুল ইসলামের কাছে এক কপি গচ্ছিত ছিল। এগুলো প্রচার হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর গুরুত্ব অনুভব করেই তাঁকে এ দেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় আসীন করেন, আর দেশ স্বাধীন হবার এক বছরের আগেই তাঁকে এ দেশে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতিনাট্য ‘বসন্ত’ উত্সর্গ করেন নজরুলকে আর প্রথম ‘কবি’ বলে তাঁকে সম্বোধন করেন। নেতাজি সুভাষ বসু বলেছিলেন, “নজরুল-এর গান পড়ে আমার মতো বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গাইবার ইচ্ছা হতো। নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো প্রাণ-মাতানো গান কোনো প্রাদেশিক ভাষায় শুনেছি বলে মনে হয় না।” তিনি বলেছিলেন, “নজরুলের স্বপ্নটা ‘সমগ্র বাঙালি জাতির স্বপ্ন’।”
এই ইতিহাস আমাদের অনেকেরই অজানা নয়। কিন্তু তাঁকে নিয়ে গবেষণার দুয়ার উন্মোচন করা যায়। কবিভবন এখন আর আগের মতো নেই। ধুলায় মিশে গেছে। তৈরি হয়েছে নতুন ইমারত। আমরা অনেকেই সেই গুরুত্বপূর্ণ কালের সাক্ষী।
১২৪ বছরের নজরুল জয়ন্তীতে বলতে ইচ্ছে হয় রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে...’। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্য ও সংগীত জীবনে কবি যা রেখে গেছেন, তা গবেষকদের মতে, শতাব্দী পেরিয়ে আজও প্রাসঙ্গিক, আজও বিস্ময়কর। আমাদের গুরুজনরা তাঁদের মেধা ও শ্রম ব্যয় করেছেন জাতীয় কবির সৃষ্টিসম্ভারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। নজরুল আজীবন অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন, দেখিয়েছেন। তাঁর এসব জীবনাদর্শের স্ফুলিঙ্গ আমাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।
লেখক: নজরুল পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী, সাংবাদিক ও আহ্বায়ক, জেমস অফ নজরুল