শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সমন্বিত এনবিআর ইকো সিস্টেমে বিনিয়োগ জরুরি

আপডেট : ০১ জুন ২০২৩, ১২:৫৫

কোভিড মহামারি আঘাত হানার এক বছর আগে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, যা এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অনেক দেশের অর্থনীতিতে নানা প্রভাব ফেলেছে এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে, বেশির ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ সংকুচিত হয়েছে। এই সমস্ত ঘটনা এ খাত সংশ্লিষ্ট সবাইকে কীভাবে সরকার বিভিন্ন উপায়ে আরো অভ্যন্তরীণ রাজস্ব তৈরি করতে পারে, তা নিয়ে নতুন করে ভাবিয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলো আইএমএফ এবং অন্যান্য তহবিল প্রদানকারীরা ইতিমধ্যে সুপারিশ করেছে। বিভিন্ন মহলের পরামর্শে দেখা গেছে যে, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধির একটি মূল ক্ষেত্র হলো আয়করের আওতা ও আদায় বৃদ্ধি, যার বিশাল প্রবৃদ্ধির সুযোগ ও বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে।

আয়কর দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রধান উৎস এবং করদাতারাই সরকারকে কর প্রদান করে। সুতরাং, যথাসম্ভব ঝামেলামুক্তভাবে করদাতাদের কর দেওয়ার সুযোগ করে দিতে ওয়ান স্টপ সেবার মাধ্যমে কর কর্মকর্তাদের একটি ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত। এনবিআর যদি আরো ভালো পরিবেশ দিতে সক্ষম হয়, তাহলে আরো বেশি করদাতা তাদের রিটার্ন দাখিল করবে এবং শেষ পর্যন্ত আরো বেশি মানুষকে করের আওতায় আনা যাবে।

বিগত বছরগুলোতে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগ কর প্রশাসনকেও স্পর্শ করেছে। বেশ কিছু পোর্টাল এবং ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে, যা ঐতিহাসিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা টিম দ্বারা বিভিন্ন সময়ে তৈরি করা হয়েছে। যেমন: ই-টিআইএন, ই-রিটার্ন, ই-টিডিএস, পিএসআর, অফিস ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। কর সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য কর কর মেলার মতো বিদ্যমান সুন্দর ব্যবস্থাগুলোর পাশাপাশি দৃঢ়ভাবে অটোমেশন এবং সমন্বিত ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের ওপর ফোকাস করতে হবে। কিছু সময় ধরেই আমরা নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ দেখছি, তবে নীতিগুলি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সমন্বিত এনবিআর ইকো সিস্টেম থাকতে হবে। এ সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে, এপিআই ব্যবহার করে যে কোনো নতুন মডিউল তৈরি করা প্রয়োজন।

একটি নতুন করদাতার যাত্রা শুরু হয় ই-টিন তৈরির মাধ্যমে। কয়েক ক্লিকে এটি তৈরি করতে প্রক্রিয়াটি আরো সহজ হওয়া দরকার। ব্যবহারকারীদের অন্যান্য সেবা প্রদানকারী প্ল্যাটফর্ম; যেমন—সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ঋণ, শেয়ারবাজার, জমির মালিকানা, ব্যবসার মালিকানা ইত্যাদি থেকে তথ্য ই-রিটার্ন ফাইলিং সিস্টেমে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে যে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তথ্যগুলো সিনক্রোনাইজ করা হচ্ছে এবং তথ্য গোপন করা সম্ভব হবে না। যদি ইউএসএসডি ডায়ালিং ব্যবহার করে বা জনপ্রিয় লেনদেনসংক্রান্ত অ্যাপস, যেমন—বিকাশ, নগদ, দারাজ, মাই-জিপি, মাই-বিএল, মাই-রবি ইত্যাদি ব্যবহার করে এক মিনিটে নতুন ই-টিন তৈরি করা যায়, এটি ব্যবহারকারীর প্রদান করা তথ্য ব্যবহার করে করদাতার সঙ্গে যথাযথভাবে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছানোর জন্য আরো সুযোগ তৈরি করবে। এই সমন্বিত ও স্মার্ট এপিআই ব্যবস্থাপনা এনবিআরকে প্রযুক্তিগতভাবে ভবিষ্যৎ কর সংগ্রহের জন্য আরো সুবিধা প্রদান করবে।

একটি বৃহৎ অর্থনীতি হওয়ায় ভারতেও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং সে দেশের কর্তৃপক্ষ কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে—প্রযুক্তির মাধ্যমে অটোমেশন ব্যবহার করে, যা তাদের কর সংগ্রহ বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। তাদের সেন্ট্রালাইজড প্রসেসিং সেন্টার বা সিপিসি (CPC) এখন করদাতাদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিফান্ড প্রসেস করার জন্য একটি রিয়েলটাইম অ্যান্ড-টু-অ্যান্ড পরিষেবা প্রদান করছে। সিপিসি বাস্তবায়নের সঙ্গে কর ফেরত-প্রক্রিয়াকরণ প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় হয়েছে। সিপিসির কারণে এখন আয়কর কর্মী এবং কর্মকর্তাদের ট্যাক্স, সুদ এবং জরিমানা হাতে  হাতে বা কাগজে বা ক্যালকুলেটর/এক্সেল ব্যবহার করে গণনা করার প্রয়োজনীয়তা দূর করেছে। রোবোটিক প্রসেস অটোমেশন (RPA) এরকম মানবনির্ভর, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং সময়সাপেক্ষ কাজগুলি দূর করতে আরো দক্ষ পদ্ধতিতে ট্যাক্স প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এনবিআর এখন ট্যাক্স রিটার্ন প্রিপারার (টিআরপি) হিসাবে প্রাইভেট এজেন্টদের নিয়োগের জন্য একটি নতুন উদ্যোগ নিয়ে এসেছে, যেখানে তৃতীয় পক্ষের এজেন্টরা নতুন করদাতাদের আয়কর রিটার্ন প্রস্তুত এবং ফাইল করতে সহায়তা করতে সক্ষম হবে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সহজ করার জন্য অনেকগুলি এপিআই (API) যেমন— টিনের তথ্য, সঞ্চয়পত্রের বিবরণ, ই-চালান যাচাইকরণ, ই-রিটার্ন জমা দেওয়া, স্বীকৃতি ইত্যাদি প্রয়োজন। ন্যূনতম ট্যাক্স দায়বদ্ধতার সঙ্গে একজন নতুন করদাতার জন্য, এটি ১০টির কম ক্লিক এবং সর্বাধিক ১০টি ডাটা এন্ট্রি পয়েন্টে সীমাবদ্ধ করা উচিত। সমন্বিত প্ল্যাটফরম ছাড়া আয়কর মূল্যায়ন, টিআরপি লাইসেন্স ব্যবস্থাপনা এবং সামগ্রিক টিআরপি উদ্যোগ প্রত্যাশা অনুযায়ী সফল না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ অনুযায়ী, আয়কর-জিডিপি অনুপাত ২ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সমন্বিত ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ছাড়া এটা অসম্ভব। নতুন আয়কর আইন, ২০২৩-এ ডিজিটালাইজেশনের একটি পৃথক অধ্যায় রয়েছে; কিন্তু কার্যকর উপায়ে কর সংগ্রহের ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের জন্য লং টার্ম ভিশনসহ একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফরম তৈরি করা না হলে, এটি অর্থহীন রয়ে যাবে। এ সংক্রান্ত অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করার এখনই উপযুক্ত সময় এবং হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, দক্ষ পেশাজীবী, প্ল্যাটফরমের মনিটরিং এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সঠিক বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন, যা এই সমন্বিত ইকো সিস্টেম ব্যবহার করে আগামী বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ রাজস্ব উৎপন্ন করার চাবিকাঠি হবে।

সুপারিশের সারাংশ:
১. একটি সামগ্রিক আইটি কৌশলপত্র প্রয়োজন, যা একটি চমৎকার ইউজার এক্সপেরিয়েন্স প্রদানে সক্ষম ফিউচার প্রুফ প্ল্যাটফরমের জন্য সামগ্রিক ইকো সিস্টেম স্থাপত্য এবং নীতিগুলো নির্ধারণ করতে পারবে। 
২. ব্যবহারকারীদের দ্বারা ম্যানুয়াল পুনরাবৃত্তিমূলক ডাটা এন্ট্রি এড়ানোর জন্য সমস্ত মডিউলের এপিআই (API) থাকতে হবে (যেমন—বেশ কয়েকটি মডিউলে একাধিকবার ই-টিআইএন এন্ট্রি) 
৩. ই-টিআইএন তৈরি করতে হবে অতি সহজে, যাতে এটি মাত্র কয়েকটি ক্লিকে এক মিনিটের কম সময়ে করা যায়। নগদের উদাহরণ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ই-টিআইএন তৈরির প্রসেসটি আমূল পরিবর্তন করা দরকার। 
৪. প্রথম বারের করদাতাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করার প্রক্রিয়াটি খুব সহজ এবং কম সময়সাপেক্ষ করা উচিত, যাতে তারা ভবিষ্যতে নিয়মিত ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে ইতিবাচকভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারে। 
৫. ই-টিআইএনের ওপর ভিত্তি করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার প্রক্রিয়ায়, সিস্টেমে অনেক তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে; যেমন :ক) করদাতার নাম, ঠিকানা এবং বিবরণ; খ) সঞ্চয়পত্র সংশ্লিষ্ট টিডিএস পরিমাণ থেকে আয়; গ) গাড়ির মালিকদের অগ্রিম করের পরিমাণ; ঘ) পূর্ববর্তী বছরের কর, আয় এবং সম্পদের পরিমাণ; ঙ) ব্যাংকের সুদ এবং টিডিএস পরিমাণ থেকে আয়; চ) যদি BIN থাকে, সে সম্পর্কিত করের তথ্য ইত্যাদি।
৬. অনলাইনে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু ই-রিটার্ন প্রাপ্তিস্বীকার পত্রের পাশাপাশি আয়কর সার্টিফিকেট ডাউনলোডের ব্যবস্থাও থাকা প্রয়োজন। 
৭. আয়কর রিটার্ন দাখিল করার সময় করদাতাকে সময়মতো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ই-মেইল এবং এসএমএসের মতো ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা উচিত। 
৮. আয়কর রিটার্ন ফাইলিং স্ট্যাটাস সম্পর্কে ব্যাংক এবং তৃতীয় সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষগুলোকে ট্র্যাকিং এবং অবহিত করার জন্য দ্রুত পরিকল্পিতভাবে সিস্টেমগুলোর আন্তঃসংযোগ স্থাপন। 
৯. ই-টিআইএন ডাটাবেসকে অবশ্যই ব্যাংক, ভূমি জরিপ অফিস, সিটি করপোরেশন এবং জনসাধারণের লেনদেনের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে যাতে করদাতা নন, এমন ব্যক্তিদের করের আওতার মধ্যে আসতে হয় এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য রিয়েল টাইম সিস্টেম-ভিত্তিক চেক/ভ্যালিডেশন প্রক্রিয়া সবসময় সক্রিয় করা প্রয়োজন। 
১০. শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের তথ্য এবং করের তথ্য গণনা ও যাচাইয়ের জন্য সিডিবিএল (CDBL)-এর সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন প্রয়োজন।
১১. কর প্রদানের বিবরণ, আয় এবং করবর্ষ অনুযায়ী সম্পদের প্রবণতার বিবরণসহ করদাতাদের ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করদাতার জন্য একটি ড্যাশবোর্ড তৈরি করা উচিত, যা করদাতা এবং এনবিআর কর্মকর্তাদের দ্বারা অ্যাক্সেসযোগ্য হতে পারে। 
১২. ট্যাক্স রিফান্ড প্রসেসিং প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় হওয়া উচিত। 
১৩. করসংক্রান্ত তথ্য এবং ইতিবাচক রিমাইন্ডার প্রদানের জন্য রিয়েল টাইম ট্যাক্স আপডেটগুলো এসএমএস এবং ইমেল ব্যবহার করে প্রদান করা দরকার। 
১৪. দৈনন্দিন ভিত্তিতে সিনক্রোনাস এবং নিরাপদ সল্যুশন এবং এর নিরাপত্তার পাশাপাশি অপারেশনাল কেপিআইগুলো সব সময় পর্যবেক্ষণ করার জন্য দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তিসমেত সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন। 
১৫. পুরো ইকো সিস্টেম ট্রান্সফরমেশনটি সুপরিকল্পিত ও সুরক্ষিত হওয়া দরকার।

লেখক:
স্নেহাশীষ বড়ুয়া, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট; এবং সনৎ পাল চৌধুরী, আইসিটি পরামর্শক

ইত্তেফাক/ইআ