শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নদী রক্ষা কমিশন: নদী ‘কমায়’, দখলদার বাড়ায়

আপডেট : ০২ জুন ২০২৩, ২২:০০

হিসেব বলছে, বাংলাদেশে নদী আছে মোট ৮৫৭টি। ২০১৯ সালে নদীর ৫৭ হাজার ৩৯০ জন দখলদার চিহ্নিত করে ১৮ হাজার ৫৭৯ জনকে উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালে দখলদারের সংখ্যা আরো বেড়ে হয়ে যায় ৬৩ হাজার ২৪৯ জন!

দখলদারের তালিকার বাইরে সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের আওতায় ৪৮টি নদীর ৩৮ হাজার অবৈধ স্থাপনা ও দখলদারদের তালিকাও তৈরি করা হয়। কিন্তু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে সেই তালিকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী দায়িত্ব নেয়ার পর তালিকাটা সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। এই প্রকল্পে ২৯ কোটি টাকা খরচ করা হলেও কাজ কতটা হয়েছে, সুফল কতটা পাওয়া যাবে সে প্রশ্ন রয়েছে।

এই প্রকল্পের সমীক্ষায় সবচেয়ে বেশি চার হাজার ৭০৭টি স্থাপনা পাওয়া যায় কীর্তনখোলা নদীতে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে পাওয়া গেছে দুই হাজার ৪৯৩টি স্থাপনা, ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে ৮৯৪টি, ধলেশ্বরীতে ৮৮৬টি, তুরাগ নদে ৬৬১টি এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে ৪৬৮টি অবৈধ স্থাপনার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়া করতোয়ায় ৮০৭, কক্সবাজারের বাঁকখালীতে ২১৮, গোমতীতে দুই হাজার ১২০টি, পার্বত্য জেলার সাঙ্গুতে ৩৩৩ স্থাপনাসহ আরও কিছু নদীতে অবৈধ স্থাপনার তালিকা করা হয়।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘এটা আসলে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। তার আগে প্রকাশ করা ঠিক হবে না। এখন আমরা সিএস দাগ ধরে তালিকা করছি।’’

ডয়চে ভেলে

তবে সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান হাওলাদার মনে করেন, ‘‘এই তালিকা ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয়া ঠিক করা হয়নি। এতে দখলদাররা উৎসাহিত হয়, দখল আরও বেড়ে যায়। আমরা প্রথম দুটি তালিকা করার পর প্রকল্পের আওতায় সুনির্দিষ্ট ৪৮টি নদীর দখলদার চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে এসেছিলাম।’’

তার কথা, ‘‘এই তালিকা প্রকাশের ম্যান্ডেট কমিশনের আছে, আদালতই আদেশ দিয়েছেন প্রকাশ করতে। আর আইন না বুঝলে এবং কমিশনের মধ্যে অসততা থাকলে এমন হয়।’’

নদী ও দখলের সার্বিক চিত্র

নদী রক্ষা কমিশন বলছে, দেশে এখন দেশে প্রকৃতপক্ষে ৮৫৭টি নদী আছে। তবে তারা আরও যাচাই-বাছাই করে তালিকা ওয়েব সাইটে প্রকাশ করবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০১৯ সালে হাইকোর্টের আদেশে জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে প্রথম তালিকা তৈরি করে। ওই তালিকায় নদীর দখলদার ৫৭ হাজার ৩৯০ জন। এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৯ জনকে, যা মোট নদী দখলকারীর ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০২০ সালের তালিকায় দখলদার বেড়ে হয় ৬৩ হাজার ২৪৯ জন। তবে ওই তালিকায় সব জেলার তথ্য তখন পাওয়া যায়নি। এরপর আর তালিকা নিয়ে কাজ হয়নি। উল্টো তালিকা নিয়ে নানা কাহিনী চলছে।

২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংসদকে ওই তালিকার তথ্যই জানিয়ে বলেন, তালিকা ধরে উচ্ছেদ অভিযান চলছে । তিনি সংসদকে জানান, তখন পর্যন্ত নদী তীরবর্তী ২১ হাজার ৪৪৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে, উদ্ধার করা হয়েছে ৭২৩.৬২ একর জমি।

ডয়চে ভেলে

এর মধ্যে ঢাকা নদী বন্দরে ১৬ হাজার ৪২৪টি, নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরে চার হাজার ৭৬৯টি, বরিশাল নদী বন্দরে ১৪১টি, আশুগঞ্জে ৫০টি এবং নওয়াপাড়া নদী বন্দর থেকে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। সারা দেশে ১৯ হাজার ৮৭৪ জন অবৈধ নদী দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মজিবর রহমান হাওলাদার জানান, ‘‘নদী যারা দখল করেন, তারা প্রধানত ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। সাধারণ মানুষ নদী দখল করে না। আর ওই প্রভাবশালীরাই নানা কৌশলে দখল বহাল রাখতে চায়। ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে আমি একাধিক দখলদার পেয়েছি যারা সংসদ সদস্য।’’

আর এই দখল উচ্ছেদ করার প্রধান দায়িত্ব জেলা প্রশাসকদের। আইনে আরও ১৭ ধরনের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আছে । তারা সেটা না করে দখলদারদের সহায়তা করে।

বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল ইয়ার্স অ্যাসেসিয়েশন (বেলা)-র প্রধান সৈয়দা রিজওয়না হাসান বলেন, ‘‘হাইকোর্ট নদী রক্ষা কমিশনকে নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করার একটি পরিকল্পনা জমা দিতেও বলেছিলেন। কিন্তু সেটা তারা এখনো দেয়নি।’’

তিনি জানান, ‘‘সর্বশেষ যে ৪৮টি নদীর দখদলারদের যে তালিকা করা হয়েছে সেটা নদীর প্রবাহ ধরে করা হয়েছে। কিন্তু এখন সেটা সিএস খতিয়ান দেখে করা হচ্ছে। আর এই কারণে তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে না।’’

ডয়চে ভেলে

তার কথা, ‘‘হাইকোর্টের আদেশ বিভাগ ও জেলা প্রশাসন ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারছে না। আর ভূমি প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশ করেই নদী দখল করা হয়। ফলে দখলদারদের নামে রেকর্ড হয়েছে। তারা খাজনা দিয়েছে। আর বর্তমান নদী রক্ষা কমিশন দিকপালহীন। এইসব কারণে দখলদারদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না, দখল আরও বাড়ছে।’’

তিনি বলেন, ‘‘দখল উচ্ছেদের সঙ্গে আইনে ফৌজদারি মামলা করারও বিধান আছে। কিন্তু এই মামলা হলে সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও আসামি হয়ে যাবেন দখলে সহযোগিতা করার অপরাধে, তাই মামলা হয় না।’’

মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘নদী দখল ফৌজদারি অপরাধ। জেলা প্রশাসন এই মামলার উদ্যোগ নিতে পারে। আরও যারা দায়িত্বে আছেন তারাও মামলা করতে পারেন। উচ্ছেদের সঙ্গে ফৌজদারি মামলা করে নদী দখলদাররা ভয় পাবে।’’

নদী জীবন্ত সত্তা

২০১৯ সালে হাইকোর্ট তুরাগ নদসহ দেশের সব নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে। আর নদীর দখলদারকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণার আদেশ দেয়। কিন্তু এইসব ঘোষণার বাস্তব কোনো প্রতিফলন নেই। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণার পর এখন নদী জীবন্ত ব্যক্তির অধিকার ও আইনগত প্রটেকশন পাবে। কিন্তু সেজন্য তো আইন করতে হবে। জীবনহানি বা ক্ষতির যে অপরাধ সেই অপরাধে দায়ী করতে হলে আইন প্রয়োজন। কিন্তু সেই আইন করার কোনো উদ্যোগ নেই। আদালতের নির্দেশনা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই।’’

‘‘আর নদী দখলদারদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য করার যে আদেশ তা আপিল বিভাগে গিয়ে পর্যবেক্ষণ হয়ে গেছে। তারপরও সরকার চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে। আইন করতে পারে,’’ বলে মনে করেন তিনি। তার  কথা, ‘‘নদী কমিশন যে তালিকা করেছে, সেটা রাষ্ট্রপতিকেও দেয়া হয়েছে। আদালতেও আছে। তাই এই তালিকা ধরেই কাজ করা যায়। কিন্তু ২০১৯-২০ সালের পর যেন সব কিছু ঝিমিয়ে পড়েছে। এখন আর আমরা উচ্ছেদের খবরও পাই না।’’

মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিতে পারে ঋণ খেলাপিদের মতো। নদী রক্ষা কমিশনের সহায়তা নিতে পারে। তার তালিকা যদি ওয়েবসাইটে থাকে, তাহলে দখলদার কারা মানুষ তাদের নাম জানবে। এটা একটি সামাজিক চাপ সৃষ্টি করবে।’’

নদী রক্ষা কমিশন ঝিমিয়ে গেছে

রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ‘‘নদী দখল এখন সারাদেশে। আগে ঢাকা এবং বড় শহরের আশপাশের নদী দখল হতো। এখন প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায়ও নদী দখল হচ্ছে। আর দখলদাররা সবাই প্রভাবশালী। তারা ব্যবসায়ী অথবা রাজনৈতিক নেতা। প্রশাসনের সহায়তায় তারা দখল করেন। ফলে তাদের থামানো যায় না। আর নদী রক্ষা কমিশন সুপারিশ করতে পারে। তারা সরাসরি উচ্ছেদ করতে পারে না। আইনে তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। তাদের আরও শক্তিশালী করা দরকার। লোকবল দেয়া দরকার।’’

ডয়চে ভেলে

নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন নোঙরের সভাপতি সুমন শামস অভিযোগ করেন, ‘‘এখনকার কমিশন অনেকটাই নদী দখলদারদের সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের সংগঠনের চারজনকে বাদ দিয়েছি নদী দখলদারদের সহযোগী হওয়ার কারণে। কিন্তু তাদের নদী কমিশন আবার জেলা কমিটিতে জায়গা দিয়েছে।’’

তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘‘এখন নদী রক্ষা কমিশন যারা নদী নিয়ে কাজ করেন তাদের সহ্য করতে পারে না। মনে হয় তারা নদী রক্ষা নয়, অন্য কোনো এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে।’’

মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘নদী রক্ষা কমিশনকে যে ক্ষমতা দেয়া আছে সেটা ঠিকমতো প্রয়োগ করলেও অনেক কাজ হয়। আমাদের সময় হাইকোর্ট আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। আইনজীবীরা করেছেন, পরিবেশ ও নদী রক্ষায় যারা কাজ করেন, তারা সহযোগিতা করেছেন। আসল কথা হলো, যদি কমিশনের মধ্যে সমস্যা থাকে, তাহলে তো কাজ ঠিকমতো হবে না।’’

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।

ইত্তেফাক/এএএম