শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সরকারকে বিপাকে ফেলতে পৌর নির্বাচন ঠেকাতে চায় অনুপ্রবেশকারীরা

আওয়ামী লীগে প্রবেশকারীদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর বার্তা

আপডেট : ০৩ জুন ২০২৩, ০৮:০০

মেয়াদোত্তীর্ণ আটটি পৌরসভায় আগামী ১৭ জুলাই ভোটগ্রহণের তপশীল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটগ্রহণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে পৌরসভাগুলোর ভোটার তালিকাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ইসি এই নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে শুরু থেকেই কোনো কোনো পৌরসভায় নির্বাচন ঠেকাতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে স্বার্থান্বেষী চক্র। 

আওয়ামী লীগ টানা গত সাড়ে ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে বিভিন্ন পন্থায় দলটিতে অনুপ্রবেশকারীদের এই চক্রটি তফসিল ঘোষণার পরেও কোনো কোনো পৌরসভার নির্বাচন বানচালে মরিয়া। তাদের লক্ষ্য, ঘোষিত তপসিলের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকার ও ইসিকে বিপাকে ফেলা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচন কোথাও কোথাও ঠেকিয়ে দিতে পারলে সরকারকে দেশে-বিদেশে বিতর্কিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে অনুপ্রবেশকারীদের এই চক্রটি।

আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা।

সরকার, আওয়ামী লীগ, নির্বাচন এবং দেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশকারীরা যে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে—সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সে ব্যাপারে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছেন। জাপান সফরকালে গত ৪ মে সেখানকার আওয়ামী লীগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ‘জামায়াত-বিএনপির অনেক সন্ত্রাসী রাতারাতি ভোল পালটে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জায়গায় ঢুকে পড়েছে। যখন যারা সরকারে থাকে, ব্যানার পালটে ওরা সেখানে ঢুকে পড়ে। সরকারে যেই আসুক, তাদের শুধু সরকারি দলের ব্যানারটা দরকার। যাতে সরকারি দলের ব্যানার ব্যবহার করে তারা নানা অপকর্ম করতে পারে। যত অপকর্ম, খুনখারাবি এরাই করে থাকে। তাদের ধারণা, ক্ষমতাসীন দলে থাকলে যত অপকর্মই করুক, তাদের কিছু হবে না।’     

ঐ বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে—আমাদের দলেরও কেউ কেউ নিজেদের গ্রুপ ভারি করতে ওদেরকে (অনুপ্রবেশকারীদের) আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। আমার কথা পরিষ্কার—দলের লেবাস লাগলেই অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না। কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব না। অপরাধ করলে দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’ অপরাধীরা যাতে দলে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেবিষয়ে সতর্ক থাকার জন্যও দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও সরকারপ্রধান।

তবে প্রধানমন্ত্রীর এমন সতর্কবার্তাকে আমলে নিচ্ছেন না আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা। স্বাধীনতাবিরোধীদের অনুসারীরা শুধু ছলে-কৌশলে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশই করেননি, অর্থের বিনিময়ে তারা বাগিয়ে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ দলীয় পদবিও। দলে অনুপ্রবেশ করে নানা অবৈধ পন্থায় তারা উপার্জন করেছেন অঢেল অর্থ। সেই অর্থের প্রভাব খাটিয়ে এবার তারা টার্গেট করেছে স্থানীয় সরকারের কোনো কোনো নির্বাচন বানচালের। যাতে জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে-বিদেশে সরকারকে বিতর্কিত করা যায়। লক্ষ্য পূরণে স্বার্থান্বেষী চক্রটি কোথাও কোথাও পৌরসভা নির্বাচন ঠেকাতে আদালতে যাওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

একসময় ইচ্ছাকৃতভাবে আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে বছরের পর বছর স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন আটকে রাখা হতো। বিশেষ করে, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও উপজেলা পরিষদের যারা চেয়ারম্যান থাকতেন, তাদের কেউ কেউ নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে নির্বাচন বন্ধ রেখে স্বপদে বহাল থেকে সুবিধা ভোগ করতেন। নির্ধারিত পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও কেউ কেউ এক যুগেরও বেশি সময় পদে ছিলেন—এমন উদাহরণ অগণিত। সেই পুরোনো কৌশল এবার দেখা যাচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ দেশের আটটি পৌরসভার কোথাও কোথাও।

মেয়াদ শেষে কেউ যেন ছলে-কৌশলে এক দিনের জন্যও এভাবে পদ আটকে রাখতে না পারেন, সেজন্যই মেয়াদ শেষে পৌরসভাগুলোতে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রেখে গত বছরের ৩১ মার্চ সংসদে পাশ হয়েছে ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) বিল-২০২২’। রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর গত বছরের ১১ এপ্রিল আইনটির গেজেট প্রকাশিত হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ইসি যখন দেশের আটটি মেয়াদোত্তীর্ণ পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছে, তখন কোথাও কোথাও নির্বাচন যাতে না হয় সেজন্য নানামুখী অপতত্পরতা শুরু করেছে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী চক্র।

গত বছর পাশ হওয়া পৌরসভা আইনের সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন নূতন কোনো পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করা হইলে অথবা কোনো পরিষদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইলে, নির্বাচনের মাধ্যমে নূতন পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত, উহার কার্যাবলি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন সরকারি কর্মকর্তা অথবা সরকার উপযুক্ত মনে করেন এমন কোনো ব্যক্তিকে প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ প্রদান করিতে পারিবে।’

আইন অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্প্রতি দেশের আটটি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে লিখিত (ইসি) অনুরোধ জানায়। সেই অনুযায়ী ইসি নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়ে গত ৩১ মে তপসিল ঘোষণা করেছে। আইন মোতাবেক মেয়াদোত্তীর্ণ পৌরসভাগুলোতে ইতিমধ্যে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তবে, প্রশাসক নিয়োগ এমনকি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরেও থেমে নেই অনুপ্রবেশকারী চক্র। আইন অনুযায়ী যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পৌরসভা পরিচালনায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন যখন আন্তরিক, তখন কোথাও কোথাও সরকারের সেই সদিচ্ছা ভেস্তে দিতে ষড়যন্ত্র করছেন সরকারি দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা অনুপ্রবেশকারীরা।

নির্বাচন বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতে, মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও যারা পদ আটকে রেখে সুবিধা লুটতে চান এবং সুষ্ঠু নির্বাচনকে ভয় পান, তারাই নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেন। উদাহরণ দিয়ে নির্বাচন বিষয়ে এই অভিজ্ঞরা বলছেন, চুয়াডাঙ্গার সাতটি ইউনিয়নে দীর্ঘ ১১ বছর নির্বাচন হয়নি। সীমানা জটিলতার অজুহাতে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানরা আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে নির্বাচন আটকে দিয়ে নিজেরা সুবিধা নেন। একইভাবে নীলফামারী সদরের খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে ১১ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন একই ব্যক্তি। এরকম উদাহরণের অভাব নেই। তাদের মতে, কারা জনপ্রতিনিধি হবেন সেটা নির্ধারণ করবেন সংশ্লিষ্ট পৌরসভার ভোটাররা। কেউ যদি নিজেকে জনপ্রিয় মনে করেন, তাহলে তার বা তাদের উচিত যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করা। কিন্তু সেটির পরিবর্তে যখন নির্বাচন ঠেকানোর লক্ষ্যে অপতত্পরতা চালানো হয়, তাহলে সেটির লক্ষ্য যে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা—তা স্পষ্ট।

ইত্তেফাক/এমএএম