দুনিয়া জুড়ে টাকা নিয়ে তেলেসমাতি কম হয় না! কারো জীবনে টাকা না চাইতেই আসে। যেন ‘আলাদিনের জাদুর চেরাগ’ রয়েছে তার কাছে। শুধু ঘষা দেওয়ার অপেক্ষা। আবার অনেকে টাকা উপার্জনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে ব্যর্থ। তারা ভাবে ইশ! থাকত যদি একটা টাকার গাছ, তবে কোন দুঃখই থাকত না। সেই দুঃখ নিয়ে গান হয় ‘টাকা তুমি সময় মতো আইলা না’। আবার, শুধু টাকা হলেই চলে না। সেই টাকা যদি পরিকল্পনা করে হিসাব মতো খরচ করা এবং আয় বুঝে খরচ করা না হয় তবে একদিন রাজার ভাণ্ডারও ফুরাতে সময় লাগে না। এটা যখন মানুষ বুঝল তখনই এলো বাজেট।
কীভাবে কোথা থেকে টাকা আসবে আর কোনো খাতে কত টাকা খরচ হবে তার হিসাব আগেভাগে করে রাখলে ‘ভাঁড়ারে টান’ পড়বে না। তাই, তিন সদস্যের পরিবারের যেমন একটা দৈনিক, মাসিক ও বছরের বাজেট থাকে তেমনি বাজেট থাকে, অফিসে, ব্যবসায়। বাজেট থাকে শহরের এবং দেশের।
বাজেটের শুরু :বাজেট শব্দটি এলো কোথা থেকে? বাজেট একটি ইংরেজি শব্দ যা বাংলাদেশের সরকারি বিভিন্ন নথিপত্রে ব্যবহৃত হয় বাজেট হিসেবেই। মানে বাজেটের তেমন লাগসই কোনো বাংলা শব্দ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই বাজেট শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ ‘বোওগেট’ থেকে। যার অর্থ চামড়ার ব্যাগ।
জানা যায়, ১৭২০ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে প্রথম জাতীয় বাজেট ও রাজস্বনীতি উত্থাপন করেন স্যার রবার্ট ওয়ালপোল। এর ঠিক ১৩ বছর পর ওয়ালপোল সরকারের করের বোঝা কমাতে তার রাজস্ব পরিকল্পনায় বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেমন ওয়াইন, তামাক প্রভৃতির ওপর আবগারি শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব করেন। এতে সাধারণ জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে যে ‘উইগ পিয়ার উইলিয়াম দ্য বাজেট ওপেন অর অ্যান আনসার টু এ প্যামফলেট’ নামে একটি পুস্তিকা লিখে ফেলেন। সেবারই প্রথম সরকারের রাজস্ব নীতিতে বাজেট শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু, বাজেটের আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ১৭৬০ সালে।
বাংলাদেশের বাজেট :স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। তাজউদ্দীন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন; সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এবারের বাজেট স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পঞ্চম বাজেট ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট।
বাংলাদেশের বাজেট উপস্থাপনে তাজউদ্দীন আহমদ অনন্য এক অবস্থানে রয়েছেন। তিনিই একমাত্র পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ যিনি সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী মোট ১৩ জন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া বাকিরা ছিলেন হয় অবসরপ্রাপ্ত আমলা অথবা অর্থনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী। কেউই পূর্ণ রাজনীতিবিদ নন।
বাজেট উপস্থাপনের চালচিত্র :এক অর্থবছরে দুই বার বাজেট উপস্থাপনের উদাহরণও আছে আমাদের। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন। এর পরে নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব নিয়ে মূল আর্থিক কাঠামো ঠিক রেখে নতুন করে বাজেট উপস্থাপন করেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া। আর সংসদে সমান ১২ বার বাজেট পেশ করে রেকর্ড করেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে টানা ১০ বার বাজেট দিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত রেকর্ড গড়েছেন। মুহিত শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে টানা ১০টিসহ মোট ১২টি বাজেট পেশ করেছেন। এর আগে তিনি এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-১৪ এই দুই অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ তিনটি, এ এম এস কিবরিয়া ছয়টি, এম সাইদুজ্জামান চারটি বাজেট দেন। অর্থ-উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম দুটি এবং ড. ওয়াহিদুদ্দিন মাহমুদ একটি বাজেট পেশ করেন। এরশাদ সরকারের দুই অর্থমন্ত্রী এম এ মুনিম দুটি এবং ড. ওয়াহিদুল হক একটি বাজেট উপস্থাপন করেন। বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ড. মীর্জা নুরুল হুদা একটি বাজেট দেন। খন্দকার মোশতাক সরকারের আমলে দেশের প্রথম টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট দেন ডক্টর এ আর মল্লিক।