বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

টিআইএন কর যারা দেবেন, যারা দেবেন না  

আপডেট : ০৪ জুন ২০২৩, ১৬:৫৬

বেড়েই চলছে করজাল। বর্তমানে দেশে ৮৮ লাখের ওপরে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনধারী রয়েছেন। আগে টিআইএন থাকলেই হতো। এখন টিআইএন থাকলেই করযোগ্য আয় থাকুক বা না থাকুক আয়কর রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক। আয়কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন নেওয়ার পর কারও আয় কমে গেলে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতির সুযোগ আছে; এটিসহ আরও কিছু কারণে টিআইএন স্থগিতও করা যাবে, চাইলে বাতিলও।

সংসদে বাজেট উত্থাপনকালে বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘অংশীদারিত্বমূলক অংশগ্রহণ দেশের জনসাধারণের মাঝে সঞ্চারণের লক্ষ্যে করমুক্ত সীমার নিচে রয়েছে, অথচ সরকার হতে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে- এমন সব করদাতার ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি।’

সংসদে বাজেট উত্থাপনকালে বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় জানান, এখন পর্যন্ত ৮৮ লাখ টিআইএন নম্বর নিলেও হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী রিটার্ন দাখিল করেছেন ৩২ লাখ।

অর্থমন্ত্রীর বাজেটে এ কর প্রস্তাব করার পর এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তিনি করযোগ্য আয় সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ করার কথা বলেছেন। আবার রিটার্ন দাখিল করলে নূন্যতম করারোপের কথাও বলছেন।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি এ করারোপকে ‘অন্যায্য’, ‘বৈষম্যমূলক’ ও অনৈতিক বলেছে। ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। 

সিপিডি বলেছে, এতে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়বে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর সুবিধা তারা পাবে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।

অর্থমন্ত্রীর বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে ন্যূনতম করের বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘আমি আগে রিকোয়েস্ট করব আপনাদের, কাদের টিআইএন থাকতে হয়, টিআইএন বাধ্যতামূলক কাদের, সেই তালিকাটা যদি সামনে নেন, তাহলে সেখানে দেখবেন টিআইএন বাধ্যতামূলক। সাধারণ গরিব মানুষেরতো টিআইএন বাধ্যতামূলক নয়।’

কারও আয় কর আরোপযোগ্য সীমার নিচে নেমে গেলে নিবন্ধন বাতিলের সুযোগ আছে কি না-এমন জিজ্ঞাসায় এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘আপনার আয় আয়কর আরোপ যোগ্য সীমার নিচে নেমে গেলে এবং যদি আপনার মনে হয় নিকট ভবিষ্যতে আয়সীমা ন্যূনতম আয়কর প্রদানের আওতায় আসবে না, তাহলে আপনি সংশ্লিষ্ট সার্কেলের উপ-কর কমিশনার বরাবর টিআইএন বাতিলেন জন্য কারণ ব্যাখ্যা করে আবেদন করতে পারেন। উপ-কর কমিশনার অনুসন্ধান বা শুনানির মাধ্যমে অথবা আবেদনের উপর ভিত্তি করে আপনার টিআইএন এর কার্যক্রম স্থগিত বা বাতিল করতে পারেন।’

এদিকে, গত অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ৩৮টি সেবা পেতে হলে আয়কর রিটার্ন দেওয়ার প্রাপ্তিস্বীকার পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়। সেবাগুলো হলো–

পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বা পোস্টাল সেভিংস কিনতে হলে;

ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার আবেদন করলে;

ব্যাংক জমার সুদ আয় থেকে উৎস কর কর্তনে টিআইএন সনদ থাকলে ১০ শতাংশ কাটা হয়ে থাকে। না থাকলে ১৫ শতাংশ কাটা হয়। এখন থেকে টিআইএনের পরিবর্ততে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে;

সিটি করপোরেশন, জেলা সদরের পৌর এলাকা অথবা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ১০ লাখ টাকা বেশি মূল্যের জমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি, বিক্রি, দলিল হস্তান্তর, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে হলে;

যেকোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে;

গাড়ি ক্রয়, মালিকানা পরিবর্তন: দুই বা তিন চাকা ছাড়া যেকোনো মোটরগাড়ি নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়ন করতে;

সিটি করপোরেশন বা জেলা সদর, পৌরসভায় সন্তান বা পোষ্যদের আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রমের আওতায় ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল বা জাতীয় পাঠ্যক্রমের আওতায় ইংরেজি ভার্সনে ভর্তি করাতে হলে;

দেশের যেকোনো স্থানে বাণিজ্যিক বা শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সংযোগ নিতে হলে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় বাসা বাড়ির গ্যাসের সংযোগ নিতে বা আগের সংযোগ বজায় রাখতে হলে;

সিটি করপোরেশন বা সেনানিবাস এলাকায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে হলে;

জমি বা বাড়ি ভাড়া দিয়ে অনেকে আয় করে থাকেন। আয় যাই হোক না কেন, এই ধরনের আয়ের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সরকার বা সরকারি কোনো সংস্থা, করপোরেশন থেকে বেতন হিসাবে মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা বা বেশি হলে;

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন নেওয়ার সময়;

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি অংশ বা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আয় মাসে ১৬ হাজার টাকার বেশি হলে;

ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী শহরে ভবন নির্মাণের অনুমোদন চাইলে;

জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলায় কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে;

পেনশন ফান্ড, অনুমোদিত গ্র্যাচুইটি ফান্ড, স্বীকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড, অনুমোদিত সুপারএন্যুয়েশন ফান্ড এবং শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ছাড়া অন্যান্য ফান্ডের রিটার্ন দাখিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সিটি করপোরেশন বা পৌর এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন করতে হলে;

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে হলে;

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অথবা ইলেকট্রনিক উপায়ে অর্থ হস্তান্তরে কমিশন, ফি জাতীয় অর্থ পেতে;

সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের আওতায় কোনো সমিতি বা ক্লাব গঠিত হলে বা এ ধরনের ক্লাবের সদস্য হলে;

ডাক্তার, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি ইত্যাদি পেশাজীবী সংগঠনের সদস্য হলে বা সদস্য হতে চাইলে;

পরামর্শক, ক্যাটারিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, জনবল বা নিরাপত্তা সেবা দিয়ে অর্থ গ্রহণ করতে;

বিবাহ নিবন্ধক বা কাজী হিসেবে লাইসেন্স পেতে চাইলে;

আমদানি-রপ্তানির সনদ পেতে চাইলে;

আমদানির এলসি খুলতে চাইলে;

কোম্পানি পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার পদ পেতে হলে;

ব্যবসা বা বাণিজ্য সংগঠনের বা সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ;

বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে তালিকাভুক্তি বা নবায়ন করতে হলে;

বীমা বা সার্ভেয়ার হিসেবে নিবন্ধন নিতে হলে;

অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার আবেদন করলে;

ওষুধ ব্যবসার জন্য ড্রাগ লাইসেন্স থাকলে বা করাতে চাইলে অগ্নিনিরাপত্তা লাইসেন্স,

পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স পেতে চাইলে;

লঞ্চ, স্টিমার, ট্রলার, কার্গো, বার্জ ইত্যাদি নৌযানের সার্ভে সার্টিফিকেটের জন্য;

ইটভাটার অনুমোদন নিতে হলে পরিবহন সেবার ব্যবসা করলে;

কোনো কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর বা এজেন্টশিপ চাইলে;

পণ্য সরবরাহের ঠিকাদারি কাজে টেন্ডার জমা দিতে হলে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণ দিতে হবে;

এনজিও বা মাইক্রো ক্রেডিট সংস্থার জন্য বিদেশি অনুদানের ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ইত্তেফাক/এনএ