একটি বই পড়তে পড়তে এর ভেতরে হারিয়ে যাওয়া কতই না চমত্কার অনুভূতি! বইটি হতে পারে প্রেমের উপন্যাস, কল্পকথা, ইতিহাসের উপাখ্যান বা কারো জীবনী। কল্পিত চরিত্র, স্থান, কাল, কল্পনায় আঁকা ঘটনাক্রমে সাজানো হয় নাটক, উপন্যাস, গল্প যা হলো ফিকশন। কিন্তু বাস্তব চরিত্র, সত্যি ঘটনা, অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতি-বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এসবের ওপর নির্ভর করে লেখা বইকে বলা হয় নন-ফিকশন।
ফিকশন যেমন কল্পনার জগতের জানালা খুলে দেয়, পাঠককে নিয়ে যায় অন্য কোনো জগতে, নন-ফিকশন তথ্যভাণ্ডারকে করে আরো সমৃদ্ধ, জগত্টাকে আরো ভালো করে দেখার চোখ খুলে দেয়। পশ্চিমা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বর্ণনায়, ফিকশন বেশি জনপ্রিয়, তবে বিক্রি বেশি হয় নন-ফিকশন। বিশেষ করে জীবনী বা আত্মজীবনীর বিক্রি সবার ওপরে। পাঠকরা পরিচিত ব্যক্তির জীবনের আরো গভীরে ডুবে যেতে চায়—এই যুক্তি হয়তো কাজ করে এসব বইয়ের বেশি বিক্রি হওয়ার পেছনে।
কোন বইটি বা বইগুলো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে বা এখনো হচ্ছে—এর উত্তর সহজ নয়। কারণ ক্রমাগত এই তালিকা বদলায়। তারপরও কিছু বই বিক্রির দিক থেকে বেশ এগিয়ে আছে। বাজারে আসার পর থেকে চুটিয়ে বিক্রি হয়ে চলেছে এসব কিছু বইয়ের নাম আমরা জানতেই পারি—
‘ব্রিদ : দ্য নিউ সায়েন্স অব লস্ট আর্ট’
বইটির লেখক জেমস নেস্টর। লেখক মূলত পেশায় সাংবাদিক। ২০২০ সালে প্রকাশিত বইটি বিক্রি হয়েছে এক মিলিয়ন (১০ লাখ) কপিরও বেশি। মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের ওপর লেখা হয়েছে বইটি। সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক, বিবর্তন ও আধ্যাত্মিক ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো হয়েছে কীভাবে বছরের পর বছর ধরে মানুষ ভুলভাবে শ্বাস নিয়ে আসছে। শ্বাস নেওয়ার ওপর নির্ভর করে মানুষের বেঁচে থাকা, কিন্তু মানুষ ভুলে গেছে কীভাবে সঠিকভাবে শ্বাস নিতে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এটা ঘটেছে বলে ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। কীভাবে শ্বাস নেওয়ার সঠিক পদ্ধতি হারিয়ে গেল এবং কীভাবে আবার তা ফিরে পাওয়া যায় তার উপায় জানতে জেমস নেস্টর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গেছেন। শ্বাসপ্রশ্বাসের অভ্যাসে খানিকটা পরিবর্তন আনতে পারলে খেলোয়াড়রা আরো ভালো ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখাতে পারেন, হূদরোগের উপশম হয়, অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুনরুজ্জীবিত হয়। বইটি পড়ার পর হয়তো পাঠক আর আগের মতো থাকেন না!
‘অন রাইটিং ওয়েল : দ্য গাইড টু রাইটিং নন-ফিকশন’
১৯৭৬ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম জিনসারের লেখা এই বইটি এখন পর্যন্ত দেড় মিলিয়ন বা ১৫ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে বলে জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা অ্যামাজন। নন-ফিকশন কীভাবে লিখতে হবে তার সাবলীল বর্ণনা, সহজ পরামর্শ ও আপন অনুভূতি তৈরি করা ভাষার কারণে বইটি পাঠকদের কাছে সমাদৃত। শুধু নন-ফিকশনই নয়, ইন্টারনেট বা প্রত্যাহিক যে কোনো ধরনের লেখালেখিতে এই বইয়ের পরামর্শগুলো কাজে লাগবে বলেও উল্লেখ করেছে অ্যামাজন। কোনো জায়গা, ভ্রমণের গল্প, মানুষ, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, খেলা, বিনোদন, জীবনী যাই নিয়ে লিখতে চান না কেন, লেখাকে আরো মনোগ্রাহী করে তোলার উপায় জানা থাকলে ক্ষতি নেই কোনো। ‘দ্য স্পাই অ্যান্ড দ্য ট্রেইটর : দ্য গ্রেটেস্ট এসপিয়োনাজ স্টোরি অব দ্য কোল্ড ওয়ার’—আশির দশকে রাশিয়ান এক গুপ্তচরের জীবনী উঠে এসেছে ২০১৮ সালে প্রকাশিত বেন মেকিনটায়ারের লেখা এই বইতে। রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির সদস্য ওলেগ গরদিয়েভস্কিকে নিয়ে লেখা হয়েছে বইটি। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ত্বরান্বিত করার পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয়।
ওলেগ গরদিয়েভস্কির বাবা-মা দুইজনই ছিলেন কেজিবির গুপ্তচর। তাঁর লেখাপড়া রাশিয়ার খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। গোয়েন্দা হিসেবে কাজ শুরুর পর তাঁর উত্থান হয়েছিল দ্রুত, লন্ডনে সোভিয়েত রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তবে গোপনে তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্সের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। তাঁর সহায়তায় ব্রিটিশ গোয়েন্দারা কেজিবি এজেন্টদের গোমর ফাঁস করে দেয়।
বইটি পাঠকদের সামনে গোয়েন্দাদের প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের দুনিয়ার এক জগত্ খুলে দেয়, যেন তারা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন কী ঘটে চলেছে। কমিউনিজমের ওপর এক গুপ্তচরের বিতৃষ্ণা অনেকগুলো দেশের ভাগ্য বদলে দেয় বলে নিজের বর্ণনায় দেখিয়ে দেন বইটির লেখক। বইটি এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে পাঁচ লাখ কপির বেশি।
‘সে নাথিং : অ্যা ট্রু স্টোরি অব মার্ডার অ্যান্ড মেমরি ইন নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড’
লেখক ও সাংবাদিক পাট্রিক র্যাডেন কিফ ২০১৮ সালে বইটি লিখেছেন। এটি এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে এক লাখ কপির বেশি। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে নৃশংস এক হত্যাকাণ্ড ও এর পরের পরিণতি নিয়ে বইটির গল্প বিবৃত হয়েছে। গল্পের ভাঁজে ভাঁজে লেখক নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস ও বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। বিবদমান দুই পক্ষের মতামতই সাক্ষাত্কার আকারে যুক্ত করেছেন। একটি শোকের ঘটনা থেকে এক মহাকাব্যিক কাহিনির দিকে পাঠকদের ধাবিত করেছেন। ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল অ্যাওয়ার্ড, দ্য ওরওয়েল প্রাইজ, টাইম ম্যাগাজিনের বেস্ট নন-ফিকশন বুক অব দ্য ইয়ার পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে বইটি।
‘বিহেভ : দ্য বায়োলজি অব হিউম্যানস অ্যাট আওয়ার বেস্ট অ্যান্ড উয়োর্স্ট’
দুই লাখের বেশি কপি বিক্রি হওয়া এই বইটির লেখক রবার্ট এম সাপোলস্কি। প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। মানব আচরণের বৈশিষ্ট্য ও এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ওপর লেখা হয়েছে বইটি। ভালো ও খারাপ আচরণ সবকিছুর ব্যাখ্যাই আছে এতে। কেন মানুষ যে কোনো ধরনের আচরণ করে, বিজ্ঞানের ভিত্তিতে তার কারণ তুলে ধরা হয়েছে। কোনো আচরণের আগে মানুষের মস্তিষ্কে কী ঘটে, হরমোনগুলো কীভাবে মানুষের প্রতিক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে, উদ্দীপনা কীভাবে স্নায়ুতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে এসব বিষয় বইয়ের আলোচনায় স্থান পেয়েছে। নৈতিকতা, প্রতিযোগিতা, শান্তি, যুদ্ধ এরকম অনুভূতি বা আচরণ বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে বইটিতে।
‘ফ্রিকোনোমিকস : অ্যা রৌগ ইকোনোমিস্ট এক্সপ্লোর্স দ্য হিডেন সাইড অব এভরিথিং’
২০০৫ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের লেখক স্টিভ ডি লেভিট ও স্টিফেন জে ডাবনার। বইটি বিক্রি হয়েছে এ যাবত অন্তত ৪০ লাখ কপি। মানুষের আচরণগত দিক ও সামাজিক নানা ঘটনাকে অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এতে। গড়পরতা সাধারণ মানুষ যেভাবে বিশ্বকে দেখে, সেই দৃষ্টিভঙ্গিটাই পালটে দেওয়া হয়েছে বইটিতে। বইটি প্রকাশের পর হাজারো পাঠক তাঁদের নানা প্রশ্ন পাঠাতে শুরু করেন লেখকদের কাছে, তারা নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার মাধ্যমে অনেক প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন।
‘হোয়েন ব্রিদ বিকামস এয়ার’
বইটির লেখক পল কালানিথি ও আব্রাহাম ভার্গিস। বিক্রি হয়েছে দুই লাখ কপির বেশি। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় বইটি। লেখক একজন তরুণ নিউরোসার্জন। ৩৭ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে এসেও জীবন নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি এই বইতে। যিনি নিজেই অসুস্থ মানুষের চিকিত্সা করতেন, তিনি নিজে যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং বাঁচার জন্য লড়াই করতে লাগলেন, সেই অভিজ্ঞতার কথাই উঠে এসেছে বইয়ের পাতায় পাতায়। ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক, মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার চ্যালেঞ্জ, জীবনের আকুতি এসব বিষয়ে হূদয়স্পর্শী বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে আত্মজীবনীমূলক বইটিতে। এটিকে গত দশকের সেরা আত্মজীবনীর আখ্যাও দিয়েছে পেস্ট ম্যাগাজিন।