বাজেটে মহার্ঘ্য ভাতার ঘোষণা না থাকলেও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ানোর একটি প্রক্রিয়া চলছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, এটা প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার বলেছেন, বাকি কাজ অর্থ মন্ত্রণালয়ের।
মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বেতন কীভাবে বাড়ানো হচ্ছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। বেতন বৃদ্ধি জুলাই থেকে কার্যকর হতে পারে। সরকারি চাকুরেরা শতকরা ২০ ভাগ মহার্ঘ্য ভাতা দাবি করেছিলেন।
বাংলাদেশে সরকারি চাকুরেদের সর্বশেষ পে-স্কেল ঘোষণা করা হয় ২০১৫ সালে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর তাদের বেতন বাড়ার কথা। আট বছর হয়ে গেলেও করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই সময়ে আর বাড়ানো হয়নি। তবে প্রতিবছর শতকরা পাঁচ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে। সেই হিসেবে সরকারি কর্মচারীরা আট বছরে ৪০ ভাগ ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন।
কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি চাকুরেরা মোট কর্মরত জনগোষ্ঠীর পাঁচ ভাগের বেশি নয়, তাই তাদের বেতন বাড়ালে বাকিদের কী হবে? আসলে এখন প্রয়োজন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। তা না করে বেতন বাড়ালে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। মে মাসে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে মূল্যস্ফীতির হিসাব দিয়েছে তা গত এক দশকে সর্বোচ্চ ৯.৯৪ শতাংশ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ১৪ লাখ। তবে বিভিন্ন কর্পোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এই সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। চলতি অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা খাতে ৭৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা লাগছে। প্রস্তাবিত বজেটে (২০২৩-২৪) বেতন-ভাতা বাবদ ৭০ হাজার ৭০১ কোটি টাকা এবং পেনশন বাবদ ২৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে বরাদ্দ ৯৩ হাজার ৭০১ কোটি টাকা।
সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, পেনশনসহ অন্যান্য খরচ বাবদ মোট বাজেটের ২২ থেকে ২৮ শতাংশ ব্যয় হয়। আর গত এক দশকে সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের খরচ ২২১ ভাগ বেড়েছে। সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। সেই হিসেবে সরকারি চাকরিজীবীরা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর দেড় শতাংশেরও কম।
গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেই অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে বলে আমরা জেনেছি। আমাদের প্রতিবছর যে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেয়, এবার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে আরও কিছু বাড়িয়ে দেওয়া হবে। তবে সেটা আসলে না দেওয়ার আগে আমরা বুঝতে পারছি না যে, আমাদের কী পরিমাণ দেওয়া হবে। তবে মহার্ঘ্য ভাতা না দেয়ায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আমাদের বেতন বাড়ানোর জন্য এখন আর নতুন পে কমিশন হচ্ছে না।’
‘বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘গত আট বছরে গড়ে প্রতিবছর মূল্যস্ফীতি ছিল আট শতাংশের উপরে। আর ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয় পাঁচ শতাংশ করে। মূল্যস্ফীতির হিসেবে আমাদের পাওনা হয়েছে ৬৪ শতাংশ। কিন্তু আমরা ইনক্রিমেন্ট পেয়েছি মোট ৪০ শতাংশ । তাহলে আরও ২৪ শতাংশ আমাদের এখানেই পাওনা হয়ে গেছে। এখন যদি সরকার বলে চলতি বছরে যে মূল্যস্ফীতি সেই পরিমাণ দেওয়া হবে, তা হলে তো আমাদের প্রতি সুবিচার করা হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমরা অপেক্ষায় আছি। প্রধানমন্ত্রী বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় হয়ত পরিষ্কার করবেন আমাদের কত কী দেওয়া হবে।’
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন যা মূল্যস্ফীতি এটা দেখে প্রধানমন্ত্রী সাময়িক ক্ষতিপূরণ ভাতা দেয়ার কথা বলেছেন। কারণ, অন্য কোনো পদ্ধতিতে দিলে সেটা স্থায়ী হয়ে যায়। এখন এটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ। কীভাবে দেবে তা তারা ঠিক করবে।’
কিন্তু যারা সরকারি চাকরি করেন না তাদের সরকার কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এই যেমন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়ে পেঁয়াজের দাম কমানো হয়েছে। আরও পণ্যের ক্ষেত্রে এটা করা হবে। তবে ডলার সংকট না কাটলে অনেক কিছুই করা যাবে না। উপায় নেই।’
তার কথা, ‘মূল্যস্ফীতি না কমাতে পারলে বেতন বাড়িয়ে কোনো সমাধান হবে না। আর সরকার কৃচ্ছতা সাধনের চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের যা স্বভাব তা তো সহজে বদলায় না।’
এবার বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা আরও বাড়ানো হয়েছে। সারচার্জ সীমা তিন কোটি থেকে বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে। পাশাপাশি টিআইএন-ধারীদের মধ্যে যাদের কোনো করযোগ্য আয় নেই তাদেরও রিটার্ন সাবমিট করতে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। কর দেয়ার যোগ্যদের করের আওতায় না এনে, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, বাজেটে ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স (যেমন: ভ্যাট) বাড়ানো হচ্ছে। এই ট্যাক্স ধনী-গরিব সবাইকে সমান হারে দিতে হয়।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘এবার বাজেটে যেভাবে ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ করের ভারে পিষ্ট হবে। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। বাজেটে এটা কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেই। সরকার এখন বাজটের বাইরে গিয়ে সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে ভিন্ন উপায়ে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তো কিছু করা হয়নি। তাদের তো বেতন বাড়বে না। তাহলে তারা চলবে কীভাবে? কৃচ্ছতাসাধন তাহলে কার জন্য?’
তার কথা, ‘আমার ধারণা, রাজনৈতিক কারণে সরকার সরকারি চাকুরেদের ভিন্ন উপায়ে বেতন বাড়াতে যাচ্ছে। হয়ত সামনে নির্বাচন তাই তাদের খুশি রাখতে চাইছে। কিন্তু এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। সরকার যদি মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যবস্থা করতো, তাহলে সবার লাভ হতো। সবাই স্বস্তি পেতো।’
সিপিডির ২০১৮ সালের জরিপে দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশে বছরে কোটি টাকা আয় করেন এমন জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশ কর আওতার বাইরে আছেন। তারা সারা দেশেই ছড়িয়ে আছেন। কিন্তু তাদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে বাংলাদেশের শীর্ষের ১০ ভাগ লোকের হাতে জাতীয় আয়ের ৩৫ ভাগ। তারা যদি কমপক্ষে ১০ শতাংশ করও দেন, তাহলে জিডিপির অনুপাতে ৩.৫ শতাংশ কর সেখান থেকে আসার কথা। কিন্তু সেটা আসছে না।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমাদের পুরো কর কাঠামোর কারণেই সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছে। ধনীদের একটি বড় অংশ, যারা কর দিতে সক্ষম, তারা কর দেয় না বা কর কম দেয়। তার কর ফাঁকি দেয়। যাদের সম্পদ ও আয় বেশি, তারা বেশি কর দেবে। এটাই ন্যায়সঙ্গত কর ব্যবস্থা। কিন্তু এখানে তার উল্টো। আমাদের ইনডাইরেক্ট টাক্স তো ধনী যা দেয় গরিবও তা দেয়। এটা তো হতে পারে না।’
এই পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো কোনো সমাধান আনবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা আমাদের শ্রম বাজারের পাঁচ ভাগেরও কম। তাদের বেতন বাড়লে বাকি ৯৫ ভাগ কী করবে? মূল্যস্ফীতি সরকার যা বলছে তার চাইতে অনেক বেশি। মজুরি বাড়ার হার তার তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এবার বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল মূল্যষ্ফীতির। সরকার হয়ত সামনের চাপ সামলাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি করতে, বাজেটের বাইরে গিয়ে কোনো একটা প্রক্রিয়ায় তাদের বেতন বাড়াচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিখাত বা শ্রম বাজারে যারা আছেন, তাদের কী হবে? তারা বেতন বাড়ানোর কথা বললে তো চাকরিও চলে যেতে পারে। তাই সবাইকে স্বস্তি দিতে হলে মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো বিকল্প নেই।’
তার কথা, ‘মূল্যস্ফীতির অনেকগুলো কারণ আছে, তার মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হলে তার প্রভাবেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে। যাদের বেতন বাড়বে, তারা হয়ত সেটা সামলাতে পারবে, কিন্তু যাদের বাড়বে না, তারা কী করবে?’
প্রস্তাবিত বাজটে সরকারি চাকুরেদের আবাসন সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ছয় হাজার ৫০৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে এবং পাঁচ হাজার ২১১টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান আছে। এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিদ্যমান আবাসন সুবিধা ৮ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এর বাইরে আরও আট হাজার ৮৩৫টি ফ্ল্যাট নির্মাণ ও ৬৪ জেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ডরমেটরি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রস্তাবিত বাজেটে।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।