সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

মেসেঞ্জারে নক করে

'বিদেশি বন্ধুর উপহারের' প্রলোভন, ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে খোয়া সব টাকা

এক মামলায় দুই নাইজেরিয়ানসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৩, ০৭:৩০

রাজধানীর রামপুরা এলাকার ব্যবসায়ী জাকির হোসেন। একদিন সকালে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে একটি বার্তা দেখতে পান। সেখানে লেখা ছিল, বিমানবন্দরে আপনার ফেসবুকের বিদেশি বন্ধু ২০ লাখ টাকার উপহার পাঠিয়েছে। কিন্তু কাস্টমস ডিউটি ও বিদেশি মুদ্রার জন্য এন্টি মানিলন্ডারিং সার্টিফিকেট প্রয়োজন। এ জন্য আপনাকে ২ লাখ টাকা জমা দিতে হবে।

 এমন মেসেজ দেখে তিনি নিজেই ঐ ব্যক্তির ইনবক্সে নক করেন। এরপর মেসেজ চালাচালির এক পর্যায়ে ১ লাখ টাকায় দফারফা হয়। এই টাকা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হবে। যথারীতি জাকির হোসেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ লাখ টাকা জমা দেন। এর পরপরই ফেসবুকের মেসেঞ্জারের আইডিটি ডিঅ্যাকটিভ হয়ে যায়। তখন জাকির হোসেন বুঝতে পারেন যে, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মেসেঞ্জারে ইনবক্স করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অন্তত ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এ ধরনের অভিযোগে রামপুরা থানায় দায়ের করা মামলা তদন্ত করে এমন তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সিআইডির উপপুলিশ পরিদর্শক (ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম) রাশেদুর রহমান বাদী হয়ে দেশি-বিদেশি একটি চক্রের সদস্যদের আসামি করে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া দুই নাইজেরিয়ানসহ ১৩ জনকে আসামি করে ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং আইনের ৪(২) ধারায় সম্প্রতি আদালতে চার্জশিট দেন সিআইডির পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন, কায়েস হোসেন, শরিফুল ইসলাম, আরমান হোসেন, বিপ্লব লস্কর, এস এম রবিউল ইসলাম ওরফে মান্না, লতা আক্তার, আয়শা আক্তার, হাবিবুর রহমান, আশরাফুল ইসলাম, আল আমিন ও মিজান লস্কর এবং দুই নাইজেরিয়ান নাগরিক জন জোসেফ ওরফে আসুজু ইম্মা দিলচুয়ু ও ইমেকা ইউরিক। এদের মধ্যে কায়েস হোসেন কারাগারে আটক রয়েছেন। এ মামলায় পলাতক রয়েছেন, শরিফুল ইসলাম, আরমান হোসেন ও মিজান লস্কর। বাকিরা হাইকোর্ট থেকে জামিনে রয়েছেন। 

এ ব্যাপারে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান বলেন, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা বিভিন্ন মানুষের ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ইনবক্স করত। ঐ ব্যক্তির নামে বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে উপহার আসার লোভনীয় অফার দেয়। এই অফারের লোভের বশবর্তী হয়ে ঐ ব্যক্তি প্রতারণা শিকার হন। প্রতারক চক্রটি বিভিন্ন মানুষের কাছে ইনবক্স করে। অনেক সময় লটারিতে লাখ লাখ ডলার পাওয়ার তথ্য জানিয়ে ইনবক্স করে। কেউ যদি ঐ অফারে প্রলুব্ধ হলেই তিনি প্রতারণার শিকার হবেন। এই ঘটনাটি আমরা তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, গত ৫ জুন আদালত মামলাটির চার্জশিট আমলে নেয়। একই সঙ্গে আদালত চার্জশিট অনুযায়ী পলাতক তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করে।

মামলার তদন্তের তথ্য দিয়ে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করে মূল্যবান উপহারসামগ্রী ও বিদেশি মুদ্রা পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিত এই চক্রটি। চক্রের সদস্যদের কেউ বিমানবন্দর ও চট্টগ্রম বন্দরের ভুয়া কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে ফোনে ভুক্তভোগীদেরকে বন্ধুর পাঠানো মূল্যবান সামগ্রীর জন্য কাস্টমস ডিউটি ও বিদেশি মুদ্রার জন্য ‘এন্টি মানিলন্ডারিং সার্টিফিকেট’ বাবদ ব্যাংকে টাকা জমা দিতে বলতেন। এভাবে নানা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিত। চক্রটির সঙ্গে যুক্ত ছিল দুই নাইজেরিয়ানও।

চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, প্রতারক চক্রের সদস্য আসামি কায়েস হোসেন ভিন্ন চারটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়া আসামি শরিফুল ইসলাম ভিন্ন আটটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। অন্যদিকে আসামি আরমান হোসেন ফেসবুক প্রতারণার মাধ্যমে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক হিসাবে ২১ লাখ টাকা নেন। এভাবে সংঘবদ্ধ আসামিরা ১৩টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নেন। এছাড়া তদন্তে দেখা গেছে, আসামিরা তাদের যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম দেখিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকে হিসাব খোলেন সেসব প্রতিষ্ঠানের কোনো হদিস নেই।

এ ব্যাপারে গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে কায়েস হোসেন ও বিপ্লব লস্কর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে বিপ্লব লস্কর বলেছেন, তিনি ২০১৬ সাল থেকে দেশি-বিদেশি চক্রের সদস্য হয়ে কাজ করেন। তিনি ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে ভ্রমণ করে ঐসব দেশ থেকে বাংলাদেশে ‘ডোর টু ডোর’ বিজনেস শুরু করেন। প্রতারণায় প্রাপ্ত টাকা থেকে কমিশন রেখে বাকিটা সদস্যদের দিয়ে দিতেন তিনি। বিদেশিদের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, রিয়াসহ নানা মাধ্যমে টাকার লেনদেন হতো তার। কায়েস হোসেন আরো বলেন, তার বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ১৮টি হিসাব রয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া প্রতি লাখে তিনি ৩ হাজার টাকা করে পেতেন।

ইত্তেফাক/এমএএম