বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আজ শ্রাবণ মেঘের দিন

আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৩, ১০:৫২

‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে, দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে, ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে’...প্রকৃতিতে এরকম কোনো দৃশ্যপট নেই। তার পরও আজ রোববার পয়লা শ্রাবণ।

বর্ষার পয়লা মাস আষাঢ়ে ঝরো ঝরো মুখর দিনের দেখা মিলেছে সামান্যই। আকাশে সজল সঘন মেঘমালার আষাঢ়স্য আবহের বদলে এখন অনেকটা শরতের অনুষঙ্গ-খানিক রোদ, খানিক পশলা বৃষ্টি দেশজুড়েই। ভারী বর্ষণ ছাড়াই এবার বিদায় নিচ্ছে বাঙালির বর্ষোত্সবের মাস আষাঢ়।

প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ জনজীবনকে সারথি করে প্রকৃতিতে আজ শ্রাবণ এলো। বর্ষারই সহোদর শ্রাবণ। মুষলধারে বৃষ্টি নেই, বিলঝিলে টইটম্বুর পানি নেই, নদনদীতে ঢল নেই। বৃষ্টিহীন কেটে গেছে আষাঢ়ে অনেক দিন। আষাঢ়ের বৃষ্টিপাতেই নদীতে ঢল নামে। খাল-বিল, নদী-নালা বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর হয়ে যায়। পরিপূর্ণ বর্ষাকাল শুরু হয় বাংলাদেশে। বাঙালির শিল্প-সাহিত্যে আষাঢ় মাসের বৃষ্টিপাত নিয়ে রচিত হয়েছে বহুসংখ্যক ছড়া, কবিতা, গান, গল্প, প্রবাদ ও শ্লোলকসহ বেশুমার রচনাবলি।

আবহাওয়াবিদেরা জানান, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই সময়েও গরমের এই প্রখরতা। বারো মাসের মধ্যে শ্রাবণ প্রাণে,মনে, প্রকৃতিতে ছড়ায় আলাদা দ্যোতনা। বৃক্ষ, লতা,পাতাগুল্ম চকচকে বৈভবে সতেজ হয়ে ওঠে।  

শ্রাবণের বৃষ্টির ছোঁয়ায় কদম, হিজল, কেয়া ও যুথিকা ফুল ফুটবে। শাপলার ঐশ্বর্য নয়নাভিরাম হয়ে উঠবে। আম, কাঁঠাল, আনারসের সঙ্গে আমড়া, লটকন, পেয়ারা, করমচা, জাম্বুরা, কামরাঙ্গাসহ অসংখ্য দেশীয় ফলের সমারোহে ভরে উঠবে। বর্ষণমুখর শ্রাবণে ব্যস্ত উদয়াস্ত কাটাতে হবে কৃষকদের। আমন ধান রোপণ, পাট জাগ দেওয়া, আঁশ ছাড়ানো শুরু হয়েছে।

খনার বচন বলে :‘শ্রাবণের পুরো, ভাদ্রের বারো/ধান্য রোপণ যত পারো’, আষাঢ় কাড়ান নামকে/ শ্রাবণে কাড়ান ধানকে’, ‘পান পুঁড়লে শ্রাবণে/ খেয়ে না ফুরায় বারণে..।  বাংলা সাহিত্যের বড় অংশ শ্রাবণের অধিকারে। এ মাস যেন বিরহকাল। স্বর্ণকুমারী দেবী শ্রাবণবন্দনায় বলেছেন, ‘সখী, নব শ্রাবণ মাস/ জলদ-ঘনঘটা, দিবসে সাঁঝছটা/ ঝুপ ঝুপ ঝরিছে আকাশ!/ ঝিমকি ঝম ঝম, নিনাদ মনোরম,/ মুহুর্মুহু দামিনী-আভাস! পবনে বহে মাতি, তুহিন-কণাভাতি/ দিকে দিকে রজত উচ্ছ্বাস। বাদলা দিন আর থই থই পানিরাশির উত্তরাধিকার শ্রাবণের প্রেম-বিরহ তাড়িত কবি-সাহিত্যিকেরা কোমল করে নাম দিয়েছেন ‘শাওন’। ‘শাওন রাত’, ‘শাওন ও বৃষ্টি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সাহিত্যে এসেছে নানা প্রেক্ষিতে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা আর মান্না দে’র কণ্ঠে শ্রাবণ যেন জীবন্ত হয়ে আছে—‘শাওন রাতে যদি/ স্মরণে আসে মোরে/ বাহিরে ঝড় বহে/ নয়নে বারি ঝরে...।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মাসকে নিয়ে শিহরিত হয়েছেন :‘ধরিত্রী তাঁর অঙ্গনেতে নাচের  তালে ওঠেন মেতে,/ পুব-হাওয়া ধায় আকাশতলে, তার সাথে মোর ভাবনা চলে/ কালহারা কোন কালের পানে ছুটে...।’

ভানুসিংহ ঠাকুরের কণ্ঠে বিরহকাতরতা: সজনী গো, শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা/ নিশীথ যামিনী রে। কুঞ্জপথে সখী, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে। উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ। দমকত বিদ্যুত্, পথতরু লুণ্ঠত, থরহর কম্পত দে...।

বর্ষামঙ্গলের কবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ শ্রাবণরাগে ভেসে গেছে। ‘প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে/ যদি-না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?/ যক্ষ অতএব কুড়চি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য/ স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।’

প্রথম নারী ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী তার এক কাব্যে শ্রাবণবন্দনা করেছেন, ‘সখী, নব শ্রাবণ মাস/ জলদ-ঘনঘটা, দিবসে সাঁঝছটা/ ঝুপ ঝুপ ঝরিছে আকাশ!/ ঝিমকি ঝম ঝম, নিনাদ মনোরম,/ মুহুর্মুহু দামিনী-আভাস! পবনে বহে মাতি, তুহিন-কণাভাতি/ দিকে দিকে রজত উচ্ছ্বাস।’

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাস শ্রবণের বর্ষাকে বলেছেন বিরহ রোদন। বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ চেয়ে রদবে/ ভিজে প্যাঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে/ শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প--ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে...। শ্রাবণের পর কাশফুলের শুভ্রতা ছড়িয়ে প্রকৃতিতে আসবে শারদীয় শরত্।

এদিকে আবহাওয়াবিদেরা জানান, রোববার (১৬ জুলাই) পর্যন্ত দেশের সব জেলায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। শুক্রবার (১৪ জুলাই) দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রের ওপর সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপের কারণে বঙ্গোপসাগর থেকে গরম ও জলীয়বষ্পযুক্ত বাতাস উত্তর ও পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

 

ইত্তেফাক/আরএজে