মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

যেভাবে সম্পদে পরিণত হতে পারে ঢাকার জনঘনত্ব

আপডেট : ২০ জুলাই ২০২৩, ১৯:০১

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে প্রথম আদমশুমারিতে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। ৫০ বছর পর এখন তা প্রায় দুই কোটিতে পরিণত হয়েছে। জনসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে জনদুর্ভোগ। উন্নত জীবনের আশায় প্রতিনিয়ত গ্রামীণ এলাকার মানুষ ঢাকা শহরে অভিবাসী হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ঘিঞ্জি দালানকোঠা; বাড়ছে ভিড়, শব্দদূষণ, যানজট, বায়ু দূষণ, কার্বন নিঃসরণসহ নানাবিধ সমস্যা। বিশাল অঙ্কের জনঘনত্ব ঢাকার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে। জনসংখ্যাও পরিণত হয়েছে আতঙ্কে। অথচ, উন্নত বিশ্বে এখন জনঘনত্বকে বাসযোগ্য নগর গড়ার শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিষয়টি সামনে রেখে ‘জনঘনত্ব হতে পারে ঢাকার আশীর্বাদ’ শিরোনামে সম্প্রতি একটি গবেষণাধর্মী প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজম (সিআইএইউ)। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ডের রিসার্চ সিড গ্রান্ট ইনিশিয়েটিভ এতে সহযোগিতা করেছে। প্রামাণ্যচিত্রে ‘স্মার্ট ডেনসিটি’ গড়ে তোলা বা জনঘনত্বকে উপযুক্ত উপায়ে কাজে লাগিয়ে ঢাকা শহরের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, টেকসই ও বাসযোগ্য নগরীতে রূপান্তর নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।

সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের নির্বাহী পরিচালক স্থপতি অধ্যাপক ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ বলেন, আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে নগরায়ন ত্বরান্বিত হওয়ার সময় নগরের উচ্চ জনঘনত্বকে দেখা হয়েছিল বোঝা এবং আতঙ্ক হিসেবে। অথচ এই জনঘনত্বকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে আমরা লাভবান হতে পারি।

ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ বলেন, ঢাকায় বর্তমানে যা ঘটছে, পশ্চিমা বিশ্বে তা অন্তত দেড়শো বছর আগে ঘটে গেছে। শিল্প-বিপ্লবের পরে উনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন পশ্চিমা নগরে গ্রাম ছেড়ে আসা ছিন্নমূল মানুষেরা জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছিল। এতে সেসব নগরে জনবিস্ফোরণ ঘটে। একইসময়ে ঘিঞ্জি ও গাদাগাদি করে তৈরি হওয়া বস্তি, কলেরা মহামারী, নিদারুণ দারিদ্র্য ও নানাধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে সেসব নগর একধরনের নরকে পরিণত হয়। নিউইয়র্ক আর প্যারিসেও এমন ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে নগর এলাকার জনঘনত্ব নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে থাকে, যা আমাদের মাঝেও প্রভাব ফেলেছে।

প্রামাণ্যচিত্রটির পরিকল্পনা, পরিচালনা ও ধারাবর্ণনা করেছেন ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ। শিল্প-নির্দেশনা ও সম্পাদনায় ছিলেন ইমতিয়াজ পাভেল নীল। এছাড়া গবেষণা ও প্রযোজনা সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন এস. এম. শাফায়েত মাহমুদ, সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার, নুজহাত শামা, পাকো মেইজাস ভিলাতোরো এবং জুনজি জি। সহযোগী সিনেমাটোগ্রাফার ফয়সাল আমিন, পোস্ট-প্রোডাকশন তত্ত্বাবধানে ছিলেন অভিজিত সরকার অর্ক। শিল্প-নির্দেশনা সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন সুমাইয়া নুসরাত জারা।

প্রামাণ্যচিত্রের ধারণা সম্পর্কে বক্তব্যে ড. আদনান মোর্শেদ আরও বলেন, জনসংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই পরিকল্পনা-পেশাজীবীরা জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি তৈরি করেছেন। ভবন বা দালানের চারপাশে ‘সেটব্যাক’ বা জায়গা ছাড়ার নিয়ম এবং ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও’র মাধ্যমে একটি জমিতে ভবনের আয়তন এবং ও মোট বসবাসকারীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আশির দশকে বাংলাদেশে নগরায়নের প্রারম্ভিক পর্যায় থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোকে অন্ধ-অনুকরণ করা হয়। ফলে আমাদের নগর পরিকল্পনায় উচ্চ জনঘনত্বকে আমরা দেখি বোঝা হিসেবে। দক্ষিণ এশিয়ার নগর বাস্তবতাকে এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আমরা দুটি স্তরে ব্যর্থ হয়েছি, অতিরিক্ত জনসমাগম এবং জনঘনত্বের মধ্যে পার্থক্য করতে পারিনি।

তিনি উল্লেখ করেন, টেকসই জীবনযাপনের স্তম্ভ হিসেবে জনঘনত্বের গুরুত্বকে বিবেচনা করার বিষয়টি এখনো আমাদের পরিকল্পনা-নীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। জনঘনত্ব মানেই ঘিঞ্জি পরিবেশ বা গাদাগাদি করে বসবাস নয়। বর্ধিত জনসংখ্যাকে বোঝা হিসেবে না দেখে বরং একে সম্পদে রূপান্তর করতে হবে। নীতিনির্ধারক, নগর-প্রশাসক ও পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা মিলে কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী ও সুদুরপ্রসারি পদক্ষেপ নিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে ‘স্মার্ট ডেনসিটি’। এজন্য কমিউনিটি-নির্ভর নগর পরিকল্পনা করতে হবে। স্বল্প-জায়গায় অধিক মানুষের আবাসনের পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সেবা যুক্ত করতে হবে, যার মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ ও ভাবের আদানপ্রদান বাড়বে। উপযুক্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা, বাই-সাইকেল ও পথচারীবান্ধব ফুটপাত নগরকে বাসযোগ্য করবে। যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হলে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমবে। এতে করে যেমন যানজট কমার পাশাপাশি কমবে পরিবেশ দূষণের মাত্রা। জনঘনত্বের সুষম বণ্টনের এই ধারণাই হলো ‘স্মার্ট ডেনসিটি’, সামগ্রিকভাবে যা মানুষ, প্রকৃতি ও অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক।

গত ১২ জুলাই বিকেলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট লার্নিং নেটওয়ার্কের কনফারেন্স রুমে এ প্রামাণ্যচিত্রটির প্রারম্ভিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সিআইএইউ-এর নির্বাহী পরিচালক স্থপতি অধ্যাপক ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ এর ধারণা ব্যাখ্যা করেন। এসময় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. ডেভিড ডোল্যান্ডসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কয়েকজন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।

এরপর গত রবিবার (১৬ জুলাই) সন্ধ্যায় প্রামাণ্যচিত্রটি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটে প্রদর্শন করা হয় ও এর ওপর এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ ফজলে রেজা সুমন, রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম এবং পরিকল্পনাবিদ রিয়াজউদ্দিন। সভা সঞ্চালনা করেন স্থপতি ইনস্টিটিউটের সম্পাদক (পরিবেশ ও নগরায়ন) সুজাউল ইসলাম খান। তারা বলেন, ঢাকা শহর নিয়ে আশাবাদী হওয়ার নতুন এক দিক ফুটে ওঠেছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। বর্তমানে এখানে যে জনসংখ্যা আছে, সেটি আরও বাড়ুক –তা আমরা চাই না। বরং বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। তবে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা তৈরির সব সুযোগ আছে। প্রামাণ্যচিত্রের ধারণাটিও আমাদের মাঝে সেই আশার সঞ্চার করছে।

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন