শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

জোট নিয়ে জাপার বৈঠকে বিতর্ক, সিদ্ধান্ত আরও অপেক্ষা করার

*দলের প্রেসিডিয়াম ও এমপিদের যৌথ সভা

*এমপিদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার পক্ষে। অন্যদের প্রশ্ন, আমাদের কী লাভ?

আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০২:২৬

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কার সঙ্গে জোট বাঁধবে জাতীয় পার্টি (জাপা)? এনিয়ে গতকাল শনিবার দলের বৈঠকে যে যার হিসাব কষে ও অবস্থান থেকে মত দিলেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যরা। দেখা দিয়েছে মতান্তরও। খোদ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বক্তব্যেও দ্বিমত স্পষ্ট। চুন্নুর অবস্থানের সঙ্গে মিল রেখে দলের বেশির ভাগ এমপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার পক্ষে। প্রায় তিন ঘণ্টার বৈঠকে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে, জোট প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরও অপেক্ষা করবে জাপা।

রাজধানীর বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয় মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যদের এই যৌথ সভাকে ঘিরে দুই-তিন দিন আগে থেকেই এক ধরনের উত্তেজনা, পক্ষ-বিপক্ষ বিরাজ করছিল জাপায়। শোনা যাচ্ছিল, পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদের সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রশ্নে জনগণের দাবির পক্ষে থাকার কথা বলবেন বৈঠকে। এমনটি আঁচ করতে পেরে সরকারপন্থি এমপি-নেতারাও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন নিজেদের অবস্থান প্রকাশ্য করার। দলের ভেতরে এমন গ্রুপিংয়ের বিষয়টি জানতে পেরে জি এম কাদেরও শেষ পর্যন্ত কৌশলী অবস্থান নিয়ে ভারসাম্যমূলক কথা বলেছেন। ফলে, তেমন কোনো বাহাস বা উচ্চবাচ্য ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। 

বৈঠকে উপস্থিত থাকা জাপার একাধিক নেতা ইত্তেফাককে জানান, বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘জাপা নিজস্ব স্বকীয়তা ও আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করবে। কারো বি-টিম হয়ে আমরা রাজনীতি করতে চাই না। আমরা জনগণের পক্ষেই থাকতে চাই। দেশের মানুষের ভোটাধিকারের পক্ষে থাকতে চাই। আমাদের অবস্থান সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে।’

বৈঠক শেষে জি এম কাদের ইত্তেফাককে বলেন, ‘বৈঠকে অনেক বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। কিছু-কিছু সিদ্ধান্তও হয়েছে। দুই-তিন দিন পর হয়তো আমাদের দলের পক্ষ থেকে ব্রিফিং করে সেগুলো জানানো হবে।’

বৈঠকে উপস্থিত থাকা জাপার বেশ কয়েক জন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য ইত্তেফাককে জানান, জি এম কাদেরের বক্তব্যের কিছুটা বিপরীত অবস্থান নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। ‘দলের আদর্শে অটুট থেকে আমরা জনগণের পক্ষে থাকব’—জি এম কাদেরের এই বক্তব্যের বিপরীতে গিয়ে চুন্নু বলেছেন, ‘শুধু আদর্শ দিয়ে রাজনীতি হয় না। আদর্শের কথা বলতে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিও রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে সংসদে থাকতে হবে। সেই হিসাব করেই আমাদের রাজনীতি করা উচিত।’

বৈঠকে পার্টি চেয়ারম্যানের সঙ্গে মতান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ইত্তেফাককে বলেন, ‘ঘটনাটা আসলে সাংঘর্ষিক ছিল না। আমি বলেছি—মালয়েশিয়ার ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলেছিলেন যে, পশ্চিমাদের অনুসরণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়; আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। তার সেই কথাটি উদ্ধৃত করে আমি বলেছি—আমরা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবে ক্ষমতাও দরকার, অগামীতে যেন আরো বেশি আসন পেতে পারি—সেই লক্ষ্য রেখেই রাজনীতি করা দরকার। এর আগে পার্টি চেয়ারম্যান (জি এম কাদের) তার বক্তব্যে বলেছেন, আমাদেরকে গণতন্ত্রের পক্ষে থাকতে হবে।’

চুন্নু বলেন, ‘আসলে এটাকে মতান্তর বা বাহাস বলা ঠিক হবে না। এটাকে একাডেমিক বিতর্ক বলতে পারেন। আমি বলেছি, শুধু আদর্শ নিয়ে থাকলে হবে না, আদর্শ ও ক্ষমতা দুটোই আমাদের দরকার। আসলে চেয়ারম্যান ও আমার বক্তব্যের মধ্যে বেসিক তেমন পার্থক্য নেই।’

জাপা মহাসচিব জানান, বৈঠকে জি এম কাদের বলেছেন, ‘বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও এখন জোট ছাড়া কারো পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদেরকেও একটা জোটে যেতে হবে। এক্ষেত্রে, জনগণের ন্যায্য দাবির সঙ্গে থাকতে হবে।’ চুন্নু জানান, জি এম কাদের এটাও বলেছেন, ‘অতীতে যাদের সঙ্গে আমরা জোট করেছি, তারা প্রতিশ্রুতি রাখেননি। আবার নতুন করে কারো সঙ্গে জোটে গেলে তারাও যে প্রতিশ্রুতি রাখবেন—এটারও বা গ্যারান্টি কী।’

জাপা মহাসচিব জানান, সবশেষে এটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, জোটের বিষয়ে পার্টি চেয়ারম্যানই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবেন। এ ব্যাপারে বৈঠকে সবাই চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই পার্টি এগিয়ে যাবে বলে বৈঠকে সবাই এতমত হয়েছেন।

পার্টি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, যৌথ সভায় কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে; এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘দুটি দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকায় দেশে রক্তক্ষয়ী সংঘাত, সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। সে ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে সরকারকেই উদ্যোগ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ বের করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। জাপার বৈঠক থেকে সরকারের প্রতি এই আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়াও সিদ্ধান্ত হয়েছে, জাপা নিজস্ব স্টাইলে নিজেদের কিছু কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে। জাপা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে, জনগণের ভোটাধিকারের পক্ষে। এর পাশাপাশি নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচার বন্ধসহ জনগণের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি দেবে জাপা।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সংসদের সদস্য থাকা জাপার সিংহভাগ নেতা বৈঠকে তাদের বক্তব্যে ইনিয়ে-বিনিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই জোট গঠনের কিংবা আসন সমঝোতার কথা বলতে চেয়েছেন। যারা এমপি নন, তারা প্রশ্ন রেখে বলেছেন—যারা এমপি তাদের লাভ হচ্ছে; আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এবং তারা এমপি হলে তারাই লাভবান হবেন; কিন্তু এতে দলের এবং আমাদের কী লাভ? এমপি নন, এমন নেতাদের মত হচ্ছে— জোটের বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরও অপেক্ষা করা উচিত। উদ্ভূত পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদও তার বক্তব্যে জোট প্রশ্নে আরও অপেক্ষা করার কথা বলেছেন।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা ইত্তেফাককে বলেন, ‘পার্টির ও দেশের উন্নয়নের জন্য যেটা করা উচিত সেটাই করতে হবে বলে আমরা মত দিয়েছি।’ দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ জানান, বৈঠকে সবাই যার যার মত দিয়েছেন। জোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরো অপেক্ষা করার কথা হয়েছে। এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো যুক্ত করে কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

জানা গেছে, বৈঠকে জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ বিভিন্ন সময়ে বিদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় কিংবা সাক্ষাতে জাপার প্রতিনিধি দল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ফিরোজ রশিদ বলেছেন, এসব বৈঠকে পার্টি চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সঙ্গে সিনিয়র নেতাদেরকেও রাখা উচিত। কিন্তু, সেটা হচ্ছে না। জাপার প্রতিনিধি দলে যদি সিনিয়র নেতাদের রাখা না হয়, সেক্ষেত্রে দলের ওজন-সাংগঠনিক ভিত্তি নিয়ে বিদেশিদের মনে নেতিবাচক ধারণা জন্মাতে পারে।

ইত্তেফাক/এমএএম