শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

১২৫তম জন্মদিন

তারাশঙ্করের ডিটেলিং

আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১৫:২৫

(গত সংখ্যার পর)
সাহিত্য শুধু অনুপুঙ্খময়তার ইতিহাস নয়—সাহিত্য তার প্রকরণেও বিচিত্রগামী। ‘রাধা’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর লিখলেন, ‘দেশে তখন অনাবৃষ্টি ছিল না। যুদ্ধও না। বাংলাদেশের খেতে তখন শস্যের সমারোহ; খামারে খামারে ধানের বাখার, ছোলা-মসুরের বাখার, ভাঁড়ারে জালায় জালায় গুড় মজুত। ঢাকায় মসলিন, মুরশিদাবাদ-বিষ্ণুপুরে রেশম, গ্রামে গ্রামে আটপৌরে কাপড়ের তাঁত চলে ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। ফিরিঙ্গীরা এ দেশে এসেছে, বসেছে, কিন্তু তার ভিত পোক্ত হতে পারেনি।...তাদের কারবার ছিল তুলোর আর কাপড়ের।’

লিখতে লিখতে এখন মনে হচ্ছে, পুরুলিয়া তথা মানভূমে এমন ধ্বনিরস সমৃদ্ধ শস্যশ্যামলিত ‘বাখার’ সম্ভবই নয়। পুরুলিয়া এক প্রকারের পাষাণ ও রুখা-প্রান্তর সংবলিত অনুর্বর ভূমি—সুতরাং তার গল্প আলাদা। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এমন নেড়া বিস্তৃত জমিকে শূন্যতার প্রতীক হিসেবে তার চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন বারবার। রোমান্টিক বিষাদের মোহ-সঞ্চারে মানভূমি যেরকম লং-শট দিতে পারে; তারাশঙ্করের লালমাটির গ্রাম-জনপদে তা হবে কেন?

দেখা যাচ্ছে ফিরিঙ্গি বণিকি পুঁজির ব্যবসাদারির কথা বলেই আঞ্চলিক সমাজ-ইতিহাসের ব্যবসাপাটির আর্থিক গতির বাজারব্যবস্থার ভেতরে প্রবেশ করছেন তারাশঙ্কর; লিখছেন এমত কেতায়—ভোর থেকে সন্ধে তাঁত চলে, একথা আগেই বলেছেন; ফিরিঙ্গিদের ব্যবসা কী (তুলা আর কাপড়ের কারবার), তা-ও বলেছেন; এবারে লিখলেন, ‘তাঁতের কারবারে ইলামবাজারের তুলোর বাজার তখন মস্ত বড় মোকাম। লেনদেন চলে হাজার হাজার টাকার।’

মোকাম (আরবি শব্দ মাক্কাম) শব্দের এমন খাসা প্রয়োগ আমাকে রা কাড়তে দেয় না। কথাটা এখানে ‘ঠিকানা’ অর্থে ব্যবহূত অর্থাত্ ‘মস্ত ঠিকানা’ বলতে যা বোঝায় তাই। এরপর পলুর চাষ ও রেশমের কিছু কিছু কারবারের উল্লেখ করেই আসল প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন তারাশঙ্কর আর সেটি হচ্ছে লাক্ষা; সবচেয়ে বড় কারবার সেটির। লিখেছেন, ইলামবাজারে সবচেয়ে বড় কারবার লাক্ষার। অজয়ের কূলের কুলগাছ আর পলাশগাছে লায়ের চাষ চলত। লা থেকে রং, আলতা, গালা তৈরি হয়ে চালান যেত দিল্লি পর্যন্ত। এখানকার গালার কদর ছিল খুব। এরপর গালার আসবাব নিয়ে অপরূপ বিবরণ দিয়েছেন লেখক; চোখের সামনে ডিটেলিং-এর এক আশ্চর্য বহর খাড়া করেছেন লেখক।

সেই বিবরণের সঙ্গে ইতিহাসকে জুড়েছেন তারাশঙ্কর: এই লাইনটি লক্ষ করুন : এখানকার গালার কদর কেমন ছিল? লেখক লিখেছেন, ‘মুরশিদাবাদের দরবারে যে গালার ওপর মোহর ছাপ দিয়ে গোপনীয় পত্র পাঠানো হতো, সে গালা ছিল ইলামবাজারের’।

ফের আরো কিছু ঐতিহাসিক ডিটেলিং দেওয়া যাক—

তারাশঙ্কর লিখেছেন, ‘মুকশুদাবাদের নবাবের রঙমহল থেকে আমীর ওমরাহ-রাজা-জমিদার বাড়ির মেয়েরা সে সময় পুরোনো ভেঙে নিত্যই যে নতুন গালার চুড়ি পরতেন, জড়োয়া চুড়ির পাশেও যে চুড়ি জেল্লায় হার মানত না, সে চুড়িও ছিল ইলামবাজারের। মুরশিদাবাদের তাওয়াএফ বাঈজী-কসবীদের হাতে যে একহাত করে গালার চুড়ি বাহার দিত সেও তাই।’

প্রিয় পাঠক! তিনটি শব্দের সমাবেশ লক্ষ করুন—তাওয়াএফ বাঈজী কসবী। এই তিনটি শব্দের মধ্যবর্তী শব্দটি বাঈজী—শব্দটি সম্ভবত রাজপুতালি শব্দ; শব্দটি তত অশ্রদ্ধেয় নয়, যেমন মীরা বাঈ (বাই) কিংবা আখতারী বাঈ (বেগম আখতার) প্রমুখ। কিন্তু তারাশঙ্কর বাঈকে (বাই) জুড়লেন কসবীর সঙ্গে হাইফেন সহযোগে—তার আগে বসালেন তাওয়াএফ—শব্দের এ প্রয়োগ অত্যন্ত সচেতন প্রয়োগ। তাওয়াএফ একটি আরবি বহুবচন শব্দ, যা একবচনেও প্রয়োগ হতে পারে, যদিও তার একবচন রূপ আছে—এখানে তারাশঙ্কর নর্তকী সম্প্রদায়কে বোঝাতে তাওয়াএফ শব্দটি বেছে নিয়েছেন এবং বাইকে কসবী শব্দের সঙ্গে জুড়েছেন—‘কসবী’ ফারসি শব্দ, যা অবনমিত হয়ে ‘বেশ্যা’য় পরিণত হয়েছে, এমনিতে শব্দটির আদি অর্থ ‘হস্তশিল্পী’ বা ‘কারিগর’। রাধা উপন্যাসে নর্তকীর অবনমন ও প্রেমের উত্তরণ—আকাঙ্ক্ষার ছবি বয়েছে; বৈষ্ণবী-নর্তকীর দোলাচলের কাহিনি এই ‘রাধা’। সাধব পূর্ণিমায় এর শুরু, রাসপূর্ণিমায় এর শেষ। নারীর স্খলন—উত্তরণের দ্বন্দ্ব-দীন গল্প।

কাহিনি শুরুই হচ্ছে ‘লা’-এর চুড়ির নারী-আকাঙ্ক্ষা দিয়ে, মেয়ে চাইছে বা আবদার ধরছে মায়ের কাছে লা বা গালার চুড়ির জন্য।

তারাশঙ্করের ব্যাপারে তিনটি কথা না বললেই নয়। এক. শব্দ প্রয়োগে তারাশঙ্করের শিক্ষিত মনের পরিচয়; দুই. তাঁর কবিত্ব-শক্তি; তিন. তাঁর সাহিত্যে কথ্য শব্দের অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যবহার। সব মিলিয়ে ইতিহাস ও ভূগোলের এবং সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির তফসির বা ব্যাখ্যাও উন্মোচন।

‘লা’ শব্দটি লাক্ষার কথ্যরূপ। বোলপুর থেকে নীলোফা যখন আমাদের গাড়ি লাভপুর নিয়ে যাচ্ছেন (তাঁর ওপর দায়িত্ব বর্তেছে), তখন রাস্তার পাশে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা বোর্ডে চোখ গেল—‘লাখাটা’। অর্থাত্ লাক্ষার ঘাট—এখানে বাণিজ্যের তরি এসে লাগত। বড়ই আশ্চর্যের কথা এই যে, বন আর জঙ্গল—এই দুটি শব্দের সুচারু ব্যবহারে বন থেকে জঙ্গল এবং জঙ্গল থেকে বন—শালবন ইত্যাদি দেখাতে দেখাতে পুরো ভূগোল তুলে ধরলেন তারাশঙ্কর। যেখানে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করলেন মাটির বিবরণ-সমতট মালভূমি—সৈকত এই ভূগোল কেন মনে রাখেননি, ভেবে পেলাম না—মনে হলো, তিনি লা-মোকাম হয়ে ঠিকানা হারিয়েছেন। (সমাপ্ত)

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন