মনীষী আবুল ফজল-এর ছড়া ভাবনায় পাই—‘ছড়া যে সে লিখতে পারে না আর ইচ্ছা করলেও লেখা যায় না ছড়া। তাই বহু প্রতিভাবান লেখকও ভালো ছড়া লিখতে পারেননি।...মন দিয়েই ছড়া লেখা হয়, মনটাও তাই শিশুর মতোই হওয়া চাই। চাই শরতের আকাশের মতো সেখানে ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানো—যুক্তি আর অর্থের বাঁধন ছিঁড়ে চাই উধাও হতে পারা।’ (সূত্র : ছড়ায় ছড়ায় ছন্দ; সম্পাদনা : এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ, শিশু সাহিত্য বিতান, চট্টগ্রাম, ১৯৬৫)
আর বাংলা ছড়াসাহিত্যের দিকপাল অন্নদাশঙ্কর রায় লিখছেন, ‘ছড়া মুখে মুখে কাটবার জিনিস, লেখনীমুখে রচনা করবার জিনিস নয়। লেখনী তাকে ধরে রাখতে পারে, কিন্তু চোখ দিয়ে পড়ার জন্যে নয়, কান দিয়ে শোনার জন্যে। কান যদি বলে, এ ছড়া নয়, তবে এ ছড়া নয়। এ পদ্য। পদের সঙ্গে পদ মিলিয়ে কোনো এক ওস্তাদের নিপুণ হাতের তৈরি। কিংবা ছাঁচে ঢালা ম্যানুফ্যাকচার। পাঁচটা ছড়া দেখে একটা ছড়া নির্মাণ করা কঠিন নয়।...’ (সূত্র : প্রাগুক্ত)
অন্নদাশংকর রায়ের কথা অকাট্য। ‘পাঁচটা ছড়া দেখে একটা ছড়া নির্মাণ করা কঠিন নয়’ বলেই আমাদের আকাশ-বাতাস ছড়াময়। এই একবিংশ শতাব্দের প্রযুক্তির চরম উত্কর্ষের কালেও বাঙালি মায়েরা তাঁদের শিশুসন্তানদের ঘুম পাড়াতে সুরে সুরে গেয়ে ওঠেন বাংলার আদরণীয় সম্পদ চিরায়ত ছড়া—‘চাঁদের কপালে চাঁদ টী দিয়ে যা!’ শুধু তা-ই নয়—আন্দোলন-সংগ্রামে মিছিলে, দেওয়াল লিখনে, রাজনৈতিক পোস্টারে কিংবা দাবি আদায়ের ফেস্টুনে মুখে মুখে বা অকবির হাতেও রচিত হয়ে যায় ছড়ার পঙিক্ত। সে-কারণেই ছড়াসাহিত্যিক ফয়েজ আহ্মদ তাঁর ‘ছড়াসমগ্র্র’ (২০০৯)-এ ‘প্রাণের সন্ধান পাই’ শীর্ষক ভূমিকায় লেখেন, ‘...ছড়া আমাদের জীবনের সাথে সম্পর্কিত হয়ে গেছে।...অনেক ক্ষেত্রে ছড়া সাধারণ মানুষের কাছে অস্ত্র।’
হঠাত্ ছড়া নিয়ে লেখার উপলক্ষ্য বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সদ্য প্রকাশিত ‘ছড়াবার্ষিকী’। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৯২। এতে ছড়া সংখ্যা ৪৭৬। ইতিপূর্বে এত অধিক সংখ্যক কবি-ছড়াকারকে দুই মলাটে সূচিবদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কোনো সংকলনে—সে খবর পাওয়া যায় না। নিঃসন্দেহে এটি স্ব-কালের ছড়ার পঙিক্তমালার দলিল। দুঃসাহসী পদক্ষেপ তো বটেই।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন ‘প্রসঙ্গকথা’য় লিখেছেন, ‘ছড়াবার্ষিকী প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা স্মরণে রেখেছি তাঁদের, যাঁরা বাংলাসাহিত্যের ছড়া নির্মাণশৈলীতে এনেছেন ছন্দকৌশল। সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের ছড়ার ভুবন। আজ তাঁরা চিরতরে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন বাংলা ছড়ার প্রকৃত রূপবৈচিত্র্য।’
‘ছড়াবার্ষিকী’র সূচিপাতা সাজানো হয়েছে কবি-ছড়াকারের নামের বর্ণানুক্রম অনুযায়ী। এতে খ্যাত অখ্যাত প্রবীণ-নবীনের লেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলেও পাঠকের মননে জাত-লেখাটিই অনুরণন তুলবে, একঘেয়েমিতে আক্রান্ত করবে না। পটচিত্রকে উপজীব্য করে তৈরি ছড়াবার্ষিকীর প্রচ্ছদ বাংলা লোকজ ছড়ার শাশ্বত রূপটিরই প্রকাশক—একেবারে যথাযথ। প্রকাশনা-সৌকর্যের কারণে এ-বই হাতে না-নিয়ে উপায় নেই। ‘ছড়াবার্ষিকী’ হাতে নিয়ে বলতে চাই—বাংলা ছড়া চিরজীবী হোক।
ছড়াবার্ষিকী
প্রধান সম্পাদক : আনজীর লিটন
প্রকাশক : বাংলাদেশ শিশু একাডেমি
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মামুন হোসাইন
মূল্য : ৪০০ টাকা