কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্ম নেন ১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই। বাংলা মতে, ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ৮ শ্রাবণ। এবারে বাংলা মাসের হিসেব ধরেই তারাশঙ্করের ১২৫তম জন্মদিন পালিত হলো তাঁর জন্মভিটা বীরভূমের লাভপুরে; লেখকের উপন্যাস ধাত্রীদেবতার নামে, একটি সংগঠনের উদ্যোগে। ঐ অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ও আলোচক বক্তা ছিলাম আমি এবং আমার সঙ্গে আয়োজক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যিক সৈকত রক্ষিত। সৈকতের মনে হয়েছে, তারাশঙ্কর ডিটেলিং জানতেন না বা সে ব্যাপারে তত মনোযোগী ছিলেন না। আসলে তারাশঙ্করের ডিটেলিং হলো গ্রামীণ সমাজ-ইতিহাস-চেতনার কোরকস্বরূপ। তাঁর ডিটেলিং অব্যর্থভাবে ইতিহাসের আঁতকে স্পর্শ করে যেত। জীবনানন্দ-তারাশঙ্কর-মহাশ্বেতা বিচিত্রভাবে ইতিহাসের কালজ্ঞান সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন তিন প্রতিভা। আজকের প্রসঙ্গ তারাশঙ্কর।
তারাশঙ্করের ‘রাধা’ উপন্যাস নিয়ে আমি ঐ সভায় ডিটেলিং এবং ইতিহাস-সূত্র কীভাবে জড়ানো রয়েছে, তার নিবিড়তা ও সম্পৃক্ততা তুলে ধরেছিলাম। রাধাতত্ত্বকে তারাশঙ্কর ইতিহাসের একটি আশ্চর্য সময়ের সীমায় বেঁধেছেন। বলা যায়, রাধাতত্ত্ব-চর্চার ঐতিহাসিক একটি উপযুক্ত পটভূমি খুঁজছিলেন লেখক। তা প্রথমত এরকম—“আঠারো শতকের তৃতীয় দশক তখন শেষ হয়ে আসছে। ভারতবর্ষে মুঘল আমল। সুবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুরশিদাবাদ; একাধারে দেওয়ান ও সুবেদার ‘মতোসন উল্ মূলক আলাউদ্দৌল্লা জাফর খাঁর নসিরী জঙ্গ মুরশিদকুলী খাঁ তখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার এক অনাস্বাদিতপূর্ব শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করে সদ্য বিগত হয়েছেন। বাংলার মসনদে তখন সদস্য বসেছেন জাফর খাঁর একমাত্র জামাতা সুজাউদ্দীন—‘মতোসন উল্ মূলক সুজাউদ্দীন বাহাদুর আস্দ জঙ্গ’। রাজা সীতারাম রায় থেকে শুরু করে বাংলার সমস্ত জমিদারের সামন্ততান্ত্রিক উদ্ধতপনা বা স্বাধীনতার প্রয়াস দমিত। তাদের ঘোড়ার মতো মুখে লাগাম পরিয়ে সুবে বাংলার রথে জুড়ে বাংলার নবাবী তখন জৌলুসের রাত্রির শোভাযাত্রার মতো চলেছে।”
এখানে পাঠকদের বলে রাখি, ‘জৌলুসের রাত্রির শোভাযাত্রার মতো চলেছে’—এই বর্ণনা মুর্শিদাবাদের ব্যারা উত্সবকে অবশ্যই মনে করাবে। এখানে বর্ণনায় যে উপমা নিহিত, তা আমাদের বিস্ময় জাগায়।
একবার লেখক অনাস্বাদিতপূর্ব শান্তির কথা বলেছেন—ফের লিখলেন, “দেশে তখন নিরঙ্কুশ শান্তি”—অতঃপর লিখলেন, “চোর-ডাকাতেরা দিনের বেলায় সাপের মতো লুকিয়েছে, ডাকাত ধরা পড়লে, তাকে দুই ভাগে ভাগ করে চিরে পথের ধারের গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। রাত্রিকালেও পথের ধারে গাছের তলায় ক্লান্ত পথিক নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রা যায়।”
এই অবদি বলার পর লেখক দেশের অর্থনৈতিক সব্যস্ততার আন্দাজ দিচ্ছেন। লিখলেন, “মুরশিদাবাদ শহরে তখন টাকায় পাঁচ মণ চাল। খাদ্যসামগ্রীর বাজারদর বাঁধা। কোনো ব্যবসায়ী বাঁধা-দরের ওপর দর চড়িয়ে লাভ করতে চেষ্টা করলে ধরা পড়তে দেরি হয় না, তাকে গাধার পিঠে চড়িয়ে শহরের রাস্তায় ঘুরিয়ে আনা হয়। সে আমলের ইতিহাসের কেতাবে পাওয়া যায় যে, মাসে এক টাকা আয় হলে একজন লোক দুই বেলা পেট পুরে পোলাও-কালিয়া খেতে পারত। ১৭২৬/২৭ খ্রিষ্টাব্দ—মাত্র তিরিশ বছর পর আসছে পলাশীর যুদ্ধ, বাংলার নবাবশাহীর পতন। কিন্তু তখনই সুবে বাংলায় মুসলমান নবাবশাহীর উজ্জ্বলতম জৌলুসের আসর। বোধকরি বেলোয়ারী কাচের ঝাড়লণ্ঠনে সামাদানে বাতিগুলি নেববার আগে শেষবারের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।”
এই অবদি পড়ার পর এক আশ্চর্য রকমের ধাক্কা খাই এবং স্তব্ধ হয়ে ভাবি, আমরা সত্যিই কি ইতিহাসের গতি বুঝতে পারি? ‘কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’—কবির এ কথার মর্ম কখনো কি আমরা ঠাহর করতে পারি? কিন্তু জৌলুসের আসর তো সামনেই রয়েছে—সবখানে শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে—রাধাতত্ত্বের উন্মেষ ও বিস্তার ও অবক্ষয়ের এইই তো উপযুক্ত সময়!
কাল-পর্বের নির্বাচন লক্ষ করে আমরা কেমন অবাক হই আর ভাবি তারাশঙ্কর কোন চোখে দেখতেন এই সমাজ-সন্ধির পালটকে!
এর পরই এসে পড়ল ভূগোল।
তারাশঙ্কর লিখলেন, “জিলা বীরভূমে অজয় নদীর ধারে ইলামবাজার গঞ্জ। বড় জমজমাট গঞ্জ তখন ইলামবাজার। ইলামবাজার থেকে পশ্চিমে জনুবাজার, উত্তরে সুখবাজার পর্যন্ত নিয়ে একনাগাড় এক মস্ত জমজমাট গঞ্জ।”
লক্ষ করতে হবে, ইতিহাস মুর্শিদাবাদের, কিন্তু ভূগোল বীরভূমের। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, পুরাতন মুর্শিদাবাদ বীরভূম আর নদীয়া জেলাকে একই এক্তিয়ারে নিয়েই ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ হিসেবে পরিগণিত ছিল। মুর্শিদাবাদের জমিই নদীয়া আর বীরভূমকে দেওয়া হয়েছে। পলাশীর যুদ্ধ তো মুর্শিদাবাদেরই লড়াই, কিন্তু পলাশী এখন নদীয়া জেলার অংশ। আরো একটি কথা, বঙ্কিমচন্দ্রের আমলেও মুর্শিদাবাদ ছিল রাজশাহী প্রভিন্সের অন্তর্গত। আমার সাহিত্যের ভূগোল রাজশাহীর গা-লাগা; নিম্ন পদ্মাঞ্চল; গ্রাম-ভাষায় অঞ্চলটি ভড়। ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী পশ্চমবঙ্গের ভূমি চারভাগে ভাগা নিয়েছে। রাঢ়-বাড়-ভড় ও কালান্তর (বর্ধমান) তারাশঙ্করের লেখাতেই পাওয়া যায়। আমার বাড়ির সামনের যে নদ ভৈরব, সেই নদ ভৈরবের নদীবালি সাদা; তারাশঙ্করের নদীর বালি লাল। বোঝাই যায়, তারাশঙ্কর ভূ-প্রকৃতি যাচাই করতেন কোন চোখে।
ফের তারাশঙ্করের লেখাটিতে ফেরা যাক। এবার তিনি সারা বাংলার বিবরণ পেশ করছেন— “দেশ তখন সমৃদ্ধ। বর্গীর হাঙ্গামা তখনও বছর বিশেক দূরে।”
বর্গি হামলার বিবরণ উপন্যাসের গল্পে সাজিয়ে নিয়েছেন লেখক। লেখক তারাশঙ্কর লিখলেন, “বুলবুল কি টিয়াপাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ধান খেয়ে গেলেও লোকে খাজনা দেবার জন্য ভাবে না। দেশে তখন অনাবৃষ্টিও ছিল না। যুদ্ধও না।”
তারাশঙ্করকে চিহ্নিত করা হয়েছে অপ্রত্যক্ষ যুদ্ধপীড়িত, জমিদারি ব্যবস্থার ক্ষয়ের ও বুর্জোয়া ব্যবস্থার গতিপ্রাপ্ত যুগের লেখক হিসেবে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)