মাঝখানে মাস সাতেক বিরতি দিয়ে আবারও দলের কাউন্সিল আয়োজনে তৎপর জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের অনুসারীরা। শনিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রওশনের বৈঠকের পর দিনই গতকাল রবিবার রওশনপন্থিরা সভা করে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই কাউন্সিল আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। রাজধানীর গুলশানে বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির সভায় এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠকে রওশন সঙ্গে নিয়েছিলেন পুত্র ও রংপুর-৩ আসনের এমপি রাহিগর আল মাহি (সাদ এরশাদ), নিজের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ ও মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদকে। তাদের মধ্যে রওশন কেন্দ্রীয় কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক এবং গোলাম মসীহ সদস্যসচিব আর কাজী মামুন যুগ্ম-আহ্বায়ক। গোলাম মসীহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গতকালের এই সভায় সাদ এরশাদও উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ সভায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে। সেই কারণে আগামী কয়েকটি মাস আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ গোলাম মসীহ নিজেই তার এই বক্তব্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে ইত্তেফাকের কাছে পাঠিয়েছেন।
আর সভায় বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদ বলেছেন, ‘শিগগিরই জাপার দশম জাতীয় সম্মেলন হবে। এর পরপরই হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এই দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।’ গণভবনে বৈঠকে রওশনের সঙ্গে উপস্থিত থাকা কাজী মামুন সভায় এটাও বলেন, ‘আগামী নির্বাচন ও সংসদ অধিবেশনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতা বৈঠক করে সাংবিধানিক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন।’
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলে চলমান বিবাদের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশনের বৈঠক, এই বৈঠকের পরদিনই রওশনের অনুসারীদের নতুন করে কাউন্সিল আয়োজনে সক্রিয় হয়ে ওঠা—এর মধ্যেই ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির আমন্ত্রণে দিল্লি গেছেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিন দিনের সফরে গতকাল তিনি ঢাকা ছাড়েন। সঙ্গে গেছেন স্ত্রী ও উপদেষ্টা শেরীফা কাদের এমপি এবং জাপা চেয়ারম্যানের বিশেষ দূত মাসরুর মাওলা। বিজেপি ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করবেন জি এম কাদের।
গত দেড় বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সরকারের ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার কড়া সমালোচনা করে আসছেন জি এম কাদের। রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা বারবারই বলছেন, জাপা বর্তমান সংবিধান মেনেই নির্বাচনে যাবে। তবে জি এম কাদের বরাবরই বলছেন, ‘বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার নির্বাচনব্যবস্থা তছনছ করে দিয়েছে, তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’ নির্বাচনে অংশ নেওয়া, না নেওয়া, নিলে কার সঙ্গে জোট হবে জাপার। জি এম কাদের বলেছেন, নির্বাচন প্রাক্কালে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অন্যদিকে রওশনের সঙ্গে বর্তমানে প্রকাশ্যে থাকা জাপার সাবেক নেতারা এবং দলটির সংসদ সদস্যদেরও বেশির ভাগই বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোতেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে আসন-সমঝোতায় যাওয়ার পক্ষে। গত ৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত জাপার সংসদ সদস্য ও প্রেসিডিয়াম সদস্যদের যৌথসভায়ও উপস্থিত বেশির ভাগ এমপি কার্যত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থেকেই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মত দেন।
জানা গেছে, শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে রওশন এরশাদ সঙ্গে নিয়ে যাওয়া একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। তাতে তিনি বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির দরকার নেই। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ীই যথাসময়ে নির্বাচন হতে হবে এবং জাপা তাতে অংশ নেবে।’ এ সময় রওশন এটাও বলেছেন, জি এম কাদের সব সময় সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন এবং সরকারবিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলানোর চেষ্টা করছেন।
এর আগে মেডিক্যাল চেকআপের উদ্দেশে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে থাকাবস্থায় গত ১৯ জুলাই ঢাকায় এক বিবৃতি পাঠিয়েও রওশন বলেছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দরকার নেই, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচনে জাপা অংশ নেবে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয় না।’
দলের ভেতরে-বাইরে এমন পরিস্থিতির মধ্যে জি এম কাদেরের ভারত সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন জাপার নেতাকর্মীরা। দলটির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা ইত্তেফাককে জানান, দিল্লিতে বিভিন্ন বৈঠকে জি এম কাদের যেমন তার অবস্থানের পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরবেন, তেমনি আগামী নির্বাচনকে ঘিরে ভারতের মনোভাবও জানার চেষ্টা করবেন। ভারত সফর শেষে জি এম কাদেরের প্রকৃত অবস্থান স্পষ্ট হতে পারে।
দিল্লি যাওয়ার আগে গত ১৪ আগস্ট ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন জি এম কাদের। বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়ে জাপার অবস্থান ও ভাবনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। জবাবে জাপার পক্ষ থেকে বলা হয়, জাপা আপাতত এককভাবে ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাপার পক্ষ থেকে পিটার হাসকে এটাও জানানো হয়েছে, জাপা অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন চায়।
প্রসঙ্গত, ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় রওশন এরশাদ হঠাৎ গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর এক চিঠির মাধ্যমে জাপার দশম জাতীয় কাউন্সিল ডাকেন। গত বছরের ২৬ নভেম্বর এই কাউন্সিল হওয়ার কথা ছিল। কাউন্সিলের ঘোষণা দেওয়া রওশনের ঐ চিঠির পরদিনই তার পরিবর্তে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেয় দলটির পার্লামেন্টারি পার্টি। এ নিয়ে জাপায় বিবাদ দেখা দেয়। এ অবস্থায় জি এম কাদেরকে ‘সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা’ হিসেবে স্পিকার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ না করা পর্যন্ত গত ৩১ অক্টোবর থেকে সংসদ বর্জনেরও ঘোষণা দেয় দলটির পার্লামেন্টারি পার্টি। আগের দিন রাতে এই ঘোষণা দিলেও ‘স্পিকারের আশ্বাসে’ পরদিনই জি এম কাদেরের নেতৃত্বে সংসদে ফেরেন জাপার এমপিরা। অন্যদিকে আগের দিন রাতে রওশন এরশাদও তার ডাকা কাউন্সিল স্থগিত করেন। বিবাদের জেরে রওশনপন্থি নেতা ও দলের সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধার এক মামলায় আদালতের নিষেধাজ্ঞায় প্রায় চার মাস দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা থেকে বিরত থাকতে হয়েছে জি এম কাদেরকে।
টানা সোয়া তিন মাস দলের অভ্যন্তরে চলা বিবাদের পর গত ৯ জানুয়ারি যুক্ত বিবৃতি দিয়ে ‘ঐক্যের বার্তা’ দিয়েছিলেন রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের।
গত বছরের ৩০ অক্টোবর রওশন তার ডাকা কাউন্সিল স্থগিত ঘোষণা করার পর এ নিয়ে তৎপরতা থেকে বিরত হয়ে যান তার অনুসারীরাও। তবে গতকাল থেকে তারা নতুন করে তৎপর হয়ে উঠেছেন। নির্বাচনের আগে কাউন্সিল করে রওশনকে চেয়ারম্যান ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তাদের এই তৎপরতার মূল টার্গেট রওশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচনে সরকারের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে দলের মনোনয়ন প্রদানের কর্তৃত্ব নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। যদিও গত ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) জি এম কাদের মনোনীত প্রার্থীকেই দলীয় প্রতীক ‘লাঙ্গল’ বরাদ্দ দিয়েছে, আর রওশন মনোনীত প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।
রওশনকে সামনে রেখে যারা জাপার কাউন্সিল আয়োজনে তৎপর তাদের মধ্যে অন্যতম সাদ এরশাদ, মসিউর রহমান রাঙ্গা, গোলাম মসীহ, কাজী মামুনুর রশিদ ও জিয়াউল হক মৃধা। তাদের মধ্যে শুধু সাদ এরশাদ জাপার যুগ্ম-মহাসচিব, বাকিরা বর্তমানে জাপার কেউ নন।
রওশনপন্থিদের কাউন্সিল আয়োজনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ইত্তেফাককে বলেন, ‘জাপার কাউন্সিল করার তারা কারা? তারা তো জাপার কেউ নন। এর কোনো ভিত্তি নেই।’