সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

তারা কখনো জিনের বাদশাহ, কখনো এসপি, মোবাইল ব্যাংকিং কর্মকর্তাও

আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৩, ২১:০৩

জিনের বাদশাহ, পুলিশের এসপি সেজে প্রতারণা করা ভয়ঙ্কর এক চক্রের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা একজনের তথ্য দিয়ে অন্যজনের নামে সিম কিনে মোবাইল ব্যাংকিং নগদ ও বিকাশে অ্যাকাউন্ট খোলে। পরে সেই নম্বর থেকে জিনের বাদশাহ, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, বিকাশ-নগদ কর্মকর্তা সেজে প্রতারণা করে। এই চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ। ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে দেওয়া একটি মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর এই চক্রের নাম। 

গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন, অনিক (২২), মো. রবিউল হোসেন (২৫), সাব্বির করিম আহাম্মেদ (৩৭), জোবায়ের আলম (৩৬), মোক্তার হোসেন (২৫), অন্তু দে (২২), ফজলুল করিম নাহিদ (৩৪)। তাদেরকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয়।
 
তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির ২১৪টি সিম, একটি ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন ৮টি, ট্যাব ২টি, বাটন ফোন ৫টি, ‘নগদ পকেট ডাক্তার’ সংবলিত ডিসকাউন্ট কার্ড ৫০০টি, ‘গ্রিন বাংলা আরকেআর’ লেখা সংবলিত কার্ড হ্যাঙ্গার, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, স্যালারি শিট ও টি শার্ট, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার সিল, ভুয়া পুলিশ কার্ড, ভুয়া সাংবাদিক কার্ড, নগদ ডাকবিভাগের ডিজিটাল লেনদেনের কার্ড, বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয় পত্র।  

সোমবার (২১ আগস্ট) ইত্তেফাক অনলাইনকে এসব তথ্য জানান মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন।

৩ ধাপে ভয়ঙ্কর প্রতারণা
মূলত এই প্রতারক চক্র তিন ধাপে প্রতারণার কাজ করে। প্রতিটি ধাপেই আলাদা আলাদা গ্রুপ কাজ করে। প্রথম ধাপে প্রথম গ্রুপ বিভিন্ন মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র, আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে। এই গ্রুপ তাদের এসব তথ্য দ্বিতীয় গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। দ্বিতীয় ধাপে এই গ্রুপ এ তথ্য দিয়ে এসব নামে সিম কেনে এবং বিকাশ ও নগদে অ্যাকাউন্ট খোলে। এরপর এসব সিম তারা উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দেয় তৃতীয় গ্রুপের কাছে। তারা এসব সিম ব্যবহার করে কখনও জিনের বাদশাহ, কখনও বিকাশ বা নগদ এজেন্ট, আর কখনওবা বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা সেজে মানুষের সাথে প্রতারণা করে।  

অরুণার মোবাইলই নেই, কিন্তু সিম আছে, বিকাশ-নগদ আছে
২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মিরপুর মডেল থানায় বিকাশের মাধ্যমে প্রতারণার একটি মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলা তদন্তে গিয়ে আটক করা হয় অরুণাকে। কিন্তু অরুণা জানান, তার কোন মোবাইলই নেই, তিনি কোন মোবাইলই ব্যবহার করেন না! তাই তার কাছে কোন সিম নেই। কোন বিকাশ কিংবা নগদ অ্যাকাউন্টও নেই। পরে প্রযুক্তির সহায়তায় নিশ্চিত হওয়া যায়, এই ঘটনার সাথে অরুণার যোগসাজশ নেই। কারণ, অরুণা ঢাকায় থাকলেও সেই সিমের অবস্থান রাজশাহীতে! পরে অরুণাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সরকার স্বল্পমূল্যে চাল, ডাল, তেল দিবে বলে কিছুদিন আগে তাদের বাসায় কয়েকজন লোক আসে। তারা এজন্য তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, আইরিস (চোখের ছাপ) ও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে যায়। কিন্তু এরপর তারা আর আসেননি। মূলত স্বল্পমূল্যে চাল, তেল দেওয়ার নাম করে তাদের তথ্য হাতিয়ে নিয়েছিল অনিকের গ্রুপ। তাদের যাতে মানুষ সন্দেহ না করে এজন্য তারা মাঝে মাঝে বিভিন্ন বাসায় আটার প্যাকেট, তেলেরও বোতলও সঙ্গে নিয়ে যেত। সবাই প্রতিষ্ঠানের লোগো সম্বলিত একই ধরনের টি শার্টও পরতো।   

প্রতারক চক্রে মোবাইল ব্যাংকিং কর্মকর্তাও
ভয়ঙ্কর এই প্রতারক চক্রের সদস্যরা চাকরি করেন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশেও। গ্রেপ্তার জোবায়ের, সাব্বির, মোক্তার হোসেন ও অন্তু দে মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশনের নিয়োগকৃত কর্মকর্তা! তারা তাদের কাছে থাকা পাসওয়ার্ড এজেন্টের কাছে দিয়ে দেন। ফলে এজেন্ট সহজেই অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলতে পারে। তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানের বেধে দেওয়া মাসিক টার্গেট পূরণের জন্যই তারা এভাবে এই প্রতারক চক্রকে ‘সহযোগিতা’ করেছেন।  

৫০ টাকার সিম ৫ হাজার টাকা
সাধারণত একটি সিমের দাম ৫০ টাকা। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু সিম ১০০ টাকায়ও বিক্রি হয়। কিন্তু এ প্রতারক চক্রের সিমের দাম ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তারা যে সব সিম প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে অন্য প্রতারক চক্রের কাছে। যেহেতু এসব প্রতারক চক্র জিনের বাদশাহ, বিকাশ ,নগদ প্রতারণাসহ অন্যান্য প্রতারণার কাজে এসব সিম ব্যবহার করে তাই তাদের কাছে এসব সিমের খুব চাহিদা। এসব সিম তারা এক হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে কিনে!

তারা কখনো জিনের বাদশাহ, কখনো পুলিশের এসপি
প্রতারণার মাধ্যমে সংগৃহীত এসব সিম দিয়ে অনিকরা বিভিন্ন মানুষকে ফোন করে টাকা হাতিয়ে নেয়। তারা কখনও জিনের বাদশাহ সেজে ফোন দেয়। কখনও পুলিশের এসপি সেজে মামলা থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। আবার কখনও বিকাশ কিংবা নগদের কর্মকর্তা সেজে প্রতারণা করে।

ইত্তেফাক/এসজেড