রোববার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৬ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নিত্যপণ্যের চড়া দামে কষ্টে মানুষ

  • মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি
  • বছর জুড়ে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২০ শতাংশ
আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০১:০০

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে সবজির দাম কেন বাড়বে? এই প্রশ্ন পোশাক কারখানায় কাজ করা আকলিমার। গতকাল রাজধানীর তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে বাজার করতে আসা আকলিমা সবজির চড়া দাম নিয়ে অনেকটা হতাশ। পেঁপে, আলু ছাড়া ৫০/৬০ টাকা কেজির নীচে কোন ধরনের সবজি নেই। তিনি বলেন, সবজি ব্যবসায়ীদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বেড়েছে। শুধু সবজি নয়, গত কিছুদিনে পেঁয়াজ থেকে ডিম, চিনি, গুড়ো দুধ, এমন কি চাষের রুই মাছ সব কিছুর দামই চড়া। গত এক বছরের ব্যবধানে কোন কোন পণ্যের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে ভোক্তারা। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে স্বল্পআয়ের মানুষ।

সরকারি হিসাবে দেশে যে হারে মজুরি বৃদ্ধি পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি হারে নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর প্রভাবে সাধারণ মানুষ তার খাবারের তালিকা ছোট করছেন। কারণ খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের দামও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে, যেখানে কাটছাটের সুযোগ খুবই কম। শিক্ষা, চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে খরচ কমানোর সুযোগ নেই। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মজুরি সূচক বেড়েছে গড়ে ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশের মতো। কিন্তু এসময়ে গড় মূল্যস্ফীতির ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। অর্থাৎ যে হারে মজুরি বেড়েছে তার চেয়ে বেশি বেড়েছে নিত্যপণ্যের মূল্য। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের হিসেবে (টিসিবি) গত এক বছরে দেশে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, ডিম ও মাছ, মাংসের দাম। টিসিবির হিসেবেই, বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকা, আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা, দেশি রসুন ২২০ থেকে ২৬০ টাকা, আমদানিকৃত রসুন ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, রুই মাছ ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, প্যাকেট গুঁড়ো দুধ ৭৯০ থেকে ৮৪০ টাকা, চিনি ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা ও ফার্মের ডিমের হালি ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর ছিল যথাক্রমে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, ৬০ থেকে ৮০ টাকা, ১০০ থেকে ১২০ টাকা, ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা, ৬৯০ থেকে ৭২০ টাকা, ৮৮ থেকে ৯০ টাকা ও ৪০ থেকে ৪২ টাকা।

বিপণন সংস্থাটির হিসেবেই, গত এক বছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম ৭৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ, আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ৬৪ দশমিক ৭১ শতাংশ, রুই মাছের দাম ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, গরুর মাংসের দাম ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, প্যাকেট গুঁড়ো দুধের দাম ১৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, চিনি ৪৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও ফার্মের ডিমের দাম ২১ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেড়েছে। এরমধ্যে ডিম, চিনির দাম আরও বেশি বাড়লেও গত কয়েক দিনে তা কিছুটা কমেছে। আর পেঁয়াজের দামটা বেশি বেড়েছে ভারতের শুল্ক আরোপের কারণে। সম্প্রতি হঠাৎ করেই ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।

এদিকে এসব পণ্যের পাশাপাশি বাজারে ভোগাচ্ছে সবজির দাম। যে আলুর দাম সবসময় ২২ থেকে ২৫ টাকা কেজির মধ্যেই থাকতো। তা এখন ৪৫ টাকায় উঠে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, প্রতি বছর গ্রীষ্মের এই সময়ে সবজির দাম কিছুটা বেশি থাকে। কিন্তু এবার দেশে টানা বৃষ্টির কারণে সবজির দাম অন্যবারের তুলনায় বেশি। গতকাল রাজধানীর খুচরা কাঁচাবাজারগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সবজির মধ্যে প্রতি কেজি ঢ্যাঁড়শ, পটল ৬০ থেকে ৭০ টাকা, বেগুন ৮০ থেকে ৯০ টাকা, করল্লা ৮০ থেকে ১০০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, কাঁকড়ল ৭০ থেকে ৮০ টাকা, গাজর ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, মুলা ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৭০ টাকা, ধুন্দল ৭০ থেকে ৮০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, কচুরমুখী ৮০ টাকা ও মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচ কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৪০ টাকায়। 

মাছের দামও বেশি:দাম কম থাকায় স্বল্প আয়ের মানুষের মাছ হিসেবে তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস ছিল পছন্দের শীর্ষে। কিন্তু দাম বাড়ায় এই মাছও কিনতে এখন দু’বার ভাবতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষকে। গতকাল বাজারে আকারভেদে প্রতি কেজি পাঙ্গাস ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় ও তেলাপিয়া ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হয়। যা এক বছর আগেও যথাক্রমে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা ও ২০০ থেকে ২২০ টাকায় পাওয়া গেছে। গতকাল বাজারে রুই মাছ বিক্রি হয় ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজিতে। যা গত বছর ছিল ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাধারণ মানুষের আয় না বাড়ায় তাদের কষ্ট আরও বেড়েছে। ফলে গত এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির চাপ তীব্রভাবে অনুভব করছেন সাধারণ মানুষ। গত বছরের আগস্ট থেকে এই চাপের শুরু। এই সময়ের মধ্যে কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি। মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি গত এক দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। এক বছর ধরে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। এর মানে হলো, দেশের মানুষকে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে।

গ্রামে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি:মূল্যস্ফীতির এই চাপ শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় হিসেবে শহরের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ, অথচ গ্রামে ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতেও একই চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে শহরাঞ্চলের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে গ্রামের মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্রামে বরং মূল্যস্ফীতি কম থাকার কথা। কেননা গ্রামে উৎপাদিত পণ্য শহরে আসতে পরিবহন ব্যয় রয়েছে। আবার মধ্যস্বত্বভোগী আছে। ফলে শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি হওয়ার যৌক্তিক কারণ নেই। এর পরেও নিত্যপণ্যের দাম গ্রামে বেশি।

ইত্তেফাক/এমএএম