এক উপজেলার সরকারি বিদ্যালয় ও ভোট কেন্দ্র অন্য উপজেলায় স্থানান্তরের অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যালয়টি দুই ভাগে বিভক্ত করে শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন দুই উপজেলায়। এতে নিশ্চিত হয়ে পড়েছে চরাঞ্চালের তিনশ পরিবারের দেড় শতাধিক শিশু শিক্ষার্থীর পড়ালেখার ভবিষ্যত।
এ ছাড়া এক হাজারের বেশি ভোটারের ভোট প্রয়োগ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। ঘটনাটি চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের উত্তর খাউরিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।
এ নিয়ে ২০ আগস্ট বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহফুজা আক্তার ও ২২ আগস্ট প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) জুলেখা ইয়াসমিন কুড়িগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
বৃস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়ে যায় উত্তর চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউয়িনের খাউরিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে উত্তর খাউরিয়ার চরেই শিক্ষার্থীদের অন্যের বাড়িতে পাঠদান করাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) জুলেখা ইয়াসমিন ও সহকারী শিক্ষক এমএইচএ হাসান মাহমুদ।
এদিকে রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ইউনিয়নের চর খেদাইমারী এলাকায় ঘর নির্মাণ করে শিক্ষা কার্যক্রম করেন আবু হোসেন মোল্লা, লায়লা খাতুন ও মোবারক হোসেন নামের তিন সহকারী শিক্ষক। এতে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) জুলেখা ইয়াসমিন অভিযোগ করে বলেন, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়ে যায় চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের উত্তর খাউরিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশে বিদ্যালয়ের টিনশেড ভবনটি উত্তর খাউরিয়ার চর এলাকার পশ্চিম পাশে স্থানান্তর করেন করেন তিনি। ১২ আগস্ট পার্শবর্তী রৌমারী উপজেলার খেরুয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু বক্কর ছিদ্দিক ও ওই বিদ্যালয়ের তিন সহকারী শিক্ষক আবু হোসেন মোল্লা, লায়লা খাতুন ও মোবারক হোসেন প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ভাড়াটিয়া লোকজন দিয়ে জোর করে রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ইউনিয়নে নিয়ে যান। পরে ওই ইউনিয়নের চর খেদাইমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে খেদাইমারী এলাকায় বিদ্যালয়ের ঘর নির্মাণ করেন তারা। বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে।
ওই প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) জানান, বিদ্যালয়টি ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হওয়ার পর থেকে খাউরিয়া চর এলাকার মোন্নাফ মিয়ার বাড়িতে পাঠদান কার্যক্রম ও পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।
বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহফুজা আক্তার করেন, বিদ্যালয়টি স্থানান্তরের বিষয়ে আমাকে কোনো প্রকার অবগত না করেই লোকজন দিয়ে জোর করে রৌমারী উপজেলায় নিয়ে যান ওই বিদ্যালয়ের তিন সহকারী শিক্ষক। তার অভিযোগ, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবগত করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি তিনি। তাদের চরে বিদ্যালয় চরেই পুনঃনির্মাণ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
নয়ারহাট ইউনিয়নের উত্তর খাউরিয়ার চরের শিশু শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন, বিজয় শেখ, শিরিনা খাতুন বলেন, তারা তাদের উত্তর খাউরিয়ার চরেই বিদ্যালয় চান। রৌমারীর খেদাইমারী গ্রামে বিদ্যালয় হলে তাদের ব্রহ্মপুত্র নদের দু’টি শাখা নদী পার হয়ে যেতে হবে। এতে তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে বলে দাবি করেন ওই শিশু শিক্ষার্থীরা।
চরের স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল মতিন, জোলেখাসহ অনেকেই বলেন, বিদ্যালয়টি তাদের চরে ছিল। তাই ওইখানেই পুনঃনির্মাণ করতে হবে। এটা তাদের ভোট কেন্দ্র। তারা প্রশ্ন রেখে বলেন, তাদের শিশু সন্তানরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন অন্য উপজেলায় গিয়ে পড়ালেখা করবে? ওই বিদ্যালয়ের তিন সহকারী শিক্ষকদের সুবিধার্থে এ চরের বিদ্যালয় অন্যত্র নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। এছাড়া বিদ্যালয়টি ভোট কেন্দ্র হওয়ায় নিজেদের দখলে রাখতে নয়ারহাট ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান ও ইউপি সদস্য মইনুল ইসলাম চিলমারী উপজেলার বিদ্যালয়টি রৌমারী উপজেলায় নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছেন।
নয়ারহাট ইউনিয়ন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইনসাব আলী বলেন, এ বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানালে আমার সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেন তিনি। শুধুমাত্র ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বিদ্যালয়টি অন্য উপজেলায় নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।
অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেন সহকারী শিক্ষক আবু হোসেন মোল্লা। তিনি বলেন, উত্তর খাউরিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি রৌমারী উপজেলার সীমানায় প্রায় ৩৩ বছর ধরে ছিল। বর্তমান নয়ারহাট ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ ভাই বিদ্যালয়টি রৌমারীর খেদাইমারী এলাকায় স্থানান্তর করেছেন। আমরা তিন শিক্ষক সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
নয়ারহাট ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদের ভাষ্য, বিদ্যালয়টি ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল। পরে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা জাকির হোসেনের অনুরোধে সাময়িকভাবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ক্যাচমেন্ট এলাকার মধ্যে একটি ঘর তোলা হয়েছে। পানি কমে গেলে ঐক্যমতের ভিত্তিতে বিদ্যালয়টি পুনঃনির্মাণ করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় চিলমারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সালেহ্ সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাময়িকভাবে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরের জন্য অন্য উপজেলায় (রৌমারী) নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পানি কমে গেলে বিদ্যালয়ের নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে উত্তর খাউরিয়া এলাকাতেই।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন সরকার বলেন, এক উপজেলার বিদ্যালয়, অন্য উপজেলায় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই বিষয়ে অভিযোগ পেয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।