ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা অনেক ভালো করছে। আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক খাতে পরিণত হয়েছে ফ্রিল্যান্সিং। তবে এক্ষেত্রে আমাদের যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেই সম্ভাবনাকে আমরা এখনো সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারক মহলের সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
এখানে আমাদের এখনো কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। যেমন—বৈশ্বিক মার্কেট প্লেসে যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের যে ধরনের ইংরেজি ও আইটি বিষয়ে দক্ষতার প্রয়োজন, তা আমাদের ছেলেমেয়েদের নেই। দক্ষ জনবল, দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও বিদেশ থেকে অর্থ আনার সুব্যবস্থা না থাকায় ফ্রিল্যান্সিংয়ে আমরা তুলনামূলকভাবে এখনো পিছিয়ে রয়েছি। তার পরও বৈশ্বিক নেট দুনিয়ার হাত ধরে বাংলাদেশের অনেক তরুণ আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই সচ্ছল জীবন যাপন করছেন। তাছাড়া গড়ে তুলেছেন গাড়ি-বাড়িসহ বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ। তাদের দেখে অন্যরা উত্সাহিত হচ্ছেন। এখন সরকারের কাজ হলো তাদের এই উত্সাহ ধরে রাখা এবং এই খাত বিকাশে প্রয়োজনীয় ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা।
আমরা রোবাইয়েত দোলনের কথা জানি। তিনি একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি লেখাপড়া করেছেন ভারতের বেঙ্গালুরে থেকে। লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে যে কাজেই তিনি যুক্ত হতে যান, দেখেন যে তার বেতন ধরা হয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। পরে অনেক গভীর চিন্তাভাবনা করে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন তিনি। তার মতে, ইংরেজি ও আইটি বিষয়ে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা দক্ষতা কম থাকার কারণে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা তুলনামূলক অনেক কম উপার্জন করছেন। নতুন এই খাত নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হওয়াও প্রয়োজন। কেননা, বাংলাদেশের কী পরিমাণ মানুষ ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ফ্রিলান্সিংয়ে কর্মরতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখের কথা দাবি করা হলেও তা কতটা সত্য, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এই খাতে আয়ের পরিমাণ প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আয়ের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। যেহেতু আমাদের দেশে কর্মক্ষম ও শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেশি, তাই তাদের এই খাতের মাধ্যমে কাজে লাগাতে হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে ফ্রিল্যান্সিং খাতে দক্ষ জনবলের ক্ষেত্রে মারাত্মক সংকট রয়েছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের খাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বাংলাদেশে গত ২০০০ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জনবলে অদক্ষতার কারণে প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি হয়ে গেলেও ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশ এখনো অনেক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বৈশ্বিক ব্যবসা করার জন্য যে ধরনের ইন্টারনেট সার্ভিসে স্পিড দরকার, সেটা আমাদের নেই। যদিও গত ১০ বছরে আইটি সেক্টরের সার্ভিস অনেকটা উন্নত হয়েছে, কিন্তু এ কাজের পারিশ্রমিক বা অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আনার ভালো কোনো পথ তৈরি হয়নি। পেপল সিস্টেম এখনো বাংলাদেশে চালু হয়নি, যার দরুন ফ্রিল্যান্সাররা কষ্টে আছেন।
পেপল সিস্টেম বাংলাদেশে এখনো চালু না হওয়ায় যারা এই খাতে কাজ করেন, তারা বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করে তাদের কাজের পারিশ্রমিক দেশে আনেন। এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারলে ফ্রিল্যান্সিং আরো উন্নত হবে। দেশের ফ্রিল্যান্স খাত নিয়ে এক গবেষণায় বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের দক্ষতাসংকটের পাশাপাশি বৈশ্বিক মানদণ্ডে দেশীয়দের আয়বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। তাছাড়া অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ খাতে বৈশ্বিক মানদণ্ডে একজন পুরুষ ও নারীর ঘণ্টাপ্রতি গড় পারিশ্রমিক যথাক্রমে ৩৯ দশমিক ১ ও ৩০ মার্কিন ডলার। বিপরীতে এই খাতে বাংলাদেশি পুরুষ ও নারী গড়ে পান ১৪ ও ১০ ডলার। ডিজাইন খাতে একজন পুরুষ ও নারীর গড় পারিশ্রমিক যথাক্রমে ৩৮ দশমিক ১ ও ৬১ দশমিক ১ ডলার; বিপরীতে বাংলাদেশি পুরুষ ও নারী গড়ে পান ২০ ও ৭ ডলার। বিজনেস সার্ভিস খাতে পুরুষ ও নারীর গড় পারিশ্রমিক ৩৮ ও ৬২ দশমিক ৩ ডলার; বিপরীতে বাংলাদেশি পুরুষ ও নারীর গড় পারিশ্রমিক ২৩ ও ১৯ ডলার।
দেশের অধিকাংশ ফ্রিল্যান্সারের আন্তর্জাতিক মার্কেট প্লেসে কাজ করার আগ্রহ খুবই কম। এজন্যই তারা নিজেদের দক্ষভাবে গড়ে তুলতে পারছেন না। উচ্চ পারিশ্রমিকের কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছেন না। আমাদের দেশে সাধারণত নিম্ন পারিশ্রমিকের কাজ বেশি হয়। গেম ডেভেলপিং, বায়োমেডিক্যাল কনটেন্ট রাইটিং, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের মতো উচ্চ পারিশ্রমিকের কাজ খুব কম হয়। একটা সময় ছিল, এসব বিষয়ে লক্ষ করার মতো কোনো গ্রুপ ছিল না।
দেশে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হলে সহজেই ডলার উপার্জন করা যায়। কিন্তু উপার্জনের জন্য কাজের ক্ষেত্রে নিজেকে দক্ষভাবে গড়ে তুলতে হবে, সেই জায়গায় আর কেউ মনোযোগ দেন না। এছাড়া দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে যোগাযোগ সঠিকভাবে করতে না পারা। এসব সংকট কাটিয়ে উঠলে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররাও ভালো করতে পারবেন বলে আমরা আশা রাখি।
লেখক: সাংবাদিক ও সাংগঠনিক সম্পাদক, শ্রীশ্রী জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ বাংলাদেশ