বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

দারিদ্র্য দূরীকরণে ইসলাম

আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:০৮

পৃথিবীতে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত—ধনী ও দরিদ্র। ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য সম্পর্কে বিভিন্ন পার্থিব মতামত বিদ্যমান রয়েছে। কারও মতে, দারিদ্র্য আল্লাহ পাকের নির্ধারিত ভাগ্য। তাই একে নিয়ে দুর্ভাবনার কারণ নেই। বরং এটা তার প্রদত্ত একটা নিয়ামত। কারণ, দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী ব্যক্তিই আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য শ্রেষ্ঠ সুযোগ লাভ করে থাকেন। আর অর্থ-বৈভব মানুষের মনকে আল্লাহ পাকের স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আরেকটি মতবাদী দল, যারা ‘জাবরিয়া’ বলে খ্যাত, তারা মনে করেন, আল্লাহপাক ইচ্ছা করেই ধনী অথবা দরিদ্র—এ দুটি শ্রেণি সৃষ্টি করেছেন। উভয় শ্রেণিকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহপাক এমনিভাবে সৃষ্টি করেছেন। সেই পরীক্ষা হচ্ছে, দরিদ্রদের প্রতি ধনীর কর্তব্য পরীক্ষা আর কষ্টের মধ্যে দরিদ্রের ধৈর্য পরীক্ষা। এ উভয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে আল্লাহ পাকের তরফ থেকে উভয়ের জন্য রয়েছে পরকালের জন্য পরম পুরস্কার। এজন্য আল্লাহর সৃষ্টি এই স্বাতন্ত্র্যের বিলোপ ঘটানোর চেষ্টা করা উচিৎ নয়।

আবার একদল মনে করেন, দরিদ্র্য একটি সমস্যা হলেও এ নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। কারণ, এটি একটি অবশ্যই সমাধানযোগ্য সমস্যা। আর এর সমাধানের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বর্তায় ধনীদের ওপর। ধনীরা তাদের সম্পদ থেকে সাহায্য করবে দরিদ্রদের। এমনিভাবে দরিদ্রদের দারিদ্র্য দূর হবে। কিন্তু এই মতবাদীরা শুধু ধনীদের দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করেন, দরিদ্রদের দায়িত্ব সম্পর্কে কিছুই বলেন না, বলেন না দারিদ্র্যের মধ্যে দরিদ্রদের অল্পে তুষ্টি অথবা ধৈর্যশীলতার কথা। তাদের আরো অনেক কর্তব্যের কথা। এদিকে পুঁজিবাদীরা মনে করেন, যদিও দারিদ্র্য একটি মন্দ জিনিস, কিন্তু এর জন্য ধনীরা অথবা রাষ্ট্র দায়ী নয়। দায়ী ঐ দরিদ্র ব্যক্তি নিজে অথবা তার ভাগ্য, যে ভাগ্যের নির্মাতা স্রষ্টা স্বয়ং। আর তা মেনেই দরিদ্রজনকে সাহায্য করতে কোনো ধনী বাধ্য নয়। কমিউনিজম পুঁজিবাদী মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। কমিউনিস্টরা মনে করেন, দরিদ্রদের দারিদ্র্যের জন্য পুরোপুরি দায়ী ধনী লোকেরা তথা পুঁজিপতিরা। তারা অন্যায়ভাবে ধনের পাহাড় নির্মাণ করেন বলেই অন্যরা দরিদ্র হয়। এজন্য কমিউনিস্টরা দরিদ্রদের প্রভাবিত করেন ধনীদের বিরুদ্ধে, ধনীদের কাছ থেকে তাদের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। এমনিভাবে তারা একটি শ্রেণিসংগ্রামের সৃষ্টি করেন। স্রষ্টার আদর্শ অথবা ভূমিকায় তারা আদৌ বিশ্বাসী নন। তবে সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিস্টদের মতো ধনীক শ্রেণির উত্খাত চান না; বরং তাদের কাছ থেকে দরিদ্রদের ন্যায্য অধিকার দাবি করেন। আর তা অবশ্যই উপরোক্ত শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে নয়, যথাযথ নিয়মতান্ত্রিক পথে।

এখন দেখা যাক, এ প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে। আল-কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা জাহাদুল বালা (অর্থাৎ, কম সম্পদ ও অধিক সম্পদ এমন অবস্থা) হতে আমার কাছে পানাহ (পরিত্রাণ) চাও।’ রসুলে করিম (স.) এই বলে দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল কুফরি ওয়াল ফাকরি।’ অর্থাত্, ‘হে আল্লাহ! আমি কুফর ও দারিদ্র্য থেকে নিশ্চয়ই তোমার কাছে পানাহ চাই।’ তিনি এমনিভাবে আরো দোয়া করতেন—‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল ফাকরি ওয়াল কিল্লাতি ওয়াজ জিল্লাতি।’ অর্থাত্, ‘হে আল্লাহ! আমি দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও সম্পদের স্বল্পতা ও জিল্লাতি থেকে তোমার কাছে নিশ্চই পানাহ চাই।’ দারিদ্র্যকে কেন মুসিবত বলা হয়েছে? তার অবশ্য কারণ রয়েছে। অধিক দারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত থাকলে কোনো মহত্ কাজে আত্মনিমগ্ন থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি ইবাদত-বন্দেগিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হজরত আনাছ (রা.) ছিলেন রসুলে পাক (স.)-এর একজন বিশ্বস্ত খাদেম। তিনি একজন দরিদ্র ব্যক্তি ছিলেন। রসুলে পাক তার জন্য এই বলে দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা তাকিছর মানাহু।’ অর্থাত্, ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে (হযরত আনাছ রা.কে) প্রচুর সম্পদ দাও।’

সুতরাং এটাই সত্য যে, ধন-সম্পদের মালিক হওয়া অপরাধ নয়। তবে সেটাই অপরাধ, যদি উক্ত সম্পদ অন্যায় পথে অর্জিত হয় এবং অন্যায় পথে ব্যয়িত হয়। তেমনি দরিদ্র অবস্থায়ও থাকা উচিত নয়। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি নিয়ে আপন কর্মগুণে দারিদ্র্য মোচনের চেষ্টা করা উচিত। সম্পদ অর্জন করতে হবে ইসলামের নির্দেশিত হালাল পথে। আর এ ধরনের অর্জনের পর পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার প্রতি শোকর করা উচিত। মানব রচিত মতবাদগুলোতে দারিদ্র্য দূরীকরণে শান্তিময় প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়নি। ইসলামে আছে সেই শান্তির কথা। শান্তিপূর্ণভাবে এ সমস্যা সমাধানের কথা। সম্পদশালী ব্যক্তিদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে দান করা। ধনী ব্যক্তি তার জমানো অর্থ থেকে দরিদ্র, অসচ্ছল ব্যক্তিকে সন্তুষ্টচিত্তে এবং কোনো প্রকার প্রতিদানের আশা ছাড়াই দান করবেন। এতে তাদের হক বা অধিকার রয়েছে। এটাই ইসলামের বিধান। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। দানে দাতার সম্পদ কমে না; বরং আরো বেড়ে যায় বলে আল-কুরআনের একাধিক সুরায় ও বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বেচ্ছাদান ছাড়াও কিছু বাধ্যতামূলক দানের জন্যও কঠোর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে জাকাত ও ফিতরা উল্লেখযোগ্য। এত কিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে অভাবগ্রস্ত মানুষকে অভাব মোচনে সহায়তা করা। এর নামই ইসলাম।

ইসলাম ছাড়া মানব প্রবর্তিত বিভিন্ন মতবাদ ও ধারণায় দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্যের কষ্টে অনেক অশ্রুপাত করা হয়েছে। কিন্তু উক্ত সব মতবাদে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হওয়ারও নয়। কারণ এসবে শুধু রাজনৈতিক স্লোগানই রয়েছে, বাস্তবসম্মত পথের কোনো নির্দেশনা নেই। বরং আছে শ্রেণিসংগ্রামের নামে শ্রেণিসংঘাত বৃদ্ধি, যা ধনী অথবা দরিদ্র কারো পক্ষে সুখকর নয়। তাই  একমাত্র ইসলামি বিধানই পারে দরিদ্র মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে শান্তির সহজ পথ প্রদর্শন করতে। যে পথে কোনো সংঘাত বা অশান্তি নেই।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও ইসলামি গবেষক

ইত্তেফাক/এসকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন