রোববার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৬ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ডেঙ্গু বিস্তার রোধে মশা নিধন ও চিকিৎসা দুটোই সংকটে

ক্রমাগত চরিত্র পাল্টাচ্ছে এডিস মশা

আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:৩০

দেশে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ক্রমাগত চরিত্র পালটাচ্ছে এডিস মশা। গত বছর প্রথম ৯ মাস ১০ দিনে যত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছে এবার মৃতের সংখ্যা তার চেয়ে প্রায় ২২ গুণ বেশি। তারপরও মশক নিধন ও চিকিৎসা দুটিই সংকটে রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মশা মারার কার্যকর পদক্ষেপ নেই। দ্রুত মশা মারার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে যেহেতু এডিস মশার চরিত্র পালটেছে, তাই চিকিৎসা পদ্ধতিও পরিবর্তন করতে হবে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাপনা নির্ধারণে জাতীয় কমিটি গঠনের তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তরে বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তাররা। কিন্তু মশা মারার কাজ তো স্বাস্থ্য বিভাগের নয়। 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, চরিত্র পালটেছে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা। শুধু দিনেই নয়, এডিস মশা এখন কামড়ায় রাতেও। হোক পরিষ্কার কিংবা ময়লা, যে কোনো আবদ্ধ পানিতেই জন্মাচ্ছে এডিসের লার্ভা। শহর থেকে গ্রাম—সর্বত্রই এখন এডিস মশা। সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। দিনদিন যেন শক্তিশালী হচ্ছে এডিস মশা। তাই মশা মারার কোনো বিকল্প নেই। মশা মারতেই হবে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তরা মশা না মেরে কি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন? চিহ্নিত শত্রু মশা মারতে না পারার কারণ কি? প্রতিদিন প্রায় এক ডজনেরও বেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মশা মারার জন্য বলে আসছেন। কিন্তু মশা মারার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই কেন? এদিকে গতকাল বৃষ্টি হয়েছে। আজিমপুর অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ছিল হাঁটুসমান পানি। এই স্কুলে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন। রাজধানীর ড্রেনও যে পরিষ্কার করা হয়, সেজন্যই মূলত এখানে হাঁটুসমান পানি। বিভিন্ন দেশে দিনে কমপক্ষে দুই বার ড্রেন পরিষ্কার করে সিটি করপোরেশন কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। অর্থাৎ এডিস মশার ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। রোগীকে দ্রুত দুর্বল করে ফেলে। তিনি বলেন, যেহেতু ডেঙ্গুতে মৃত্যু হার বাড়ছে, তাই চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাপনাও পরিবর্তন করতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে জাতীয় কমিটি গঠন করে চিকিৎসা পদ্ধতির নতুন গাইডলাইন তৈরি করা উচিত বলে জানান তিনি।

গতকাল সোমবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করে ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটি জানিয়েছে, আগামীতে আরও ভয়াবহ হবে পরিস্থিতি, কঠিন হবে রোগী বাঁচানো। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাছের হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কঠিন অবস্থা মোকাবিলায় আজ মঙ্গলবারের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যালের প্রতিটি ওয়ার্ডেই চালু করা হবে বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি সব বারের চেয়ে আলাদা। যেটা অনুমান করা যাচ্ছে, আগামী দিনে আরও ভয়ংকর রূপে ডেঙ্গু আসবে। যতদিন যাবে, ততদিন খারাপভাবে রোগী হাসপাতালে আসবে। চিকিৎসকরা চেষ্টা করার পরও রোগীকে বাঁচাতে পারবে না। তাই সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে হবে।

মশার কামড়ে হাসপাতালে আসা রোগী ও তার স্বজনদের নাজেহালের দৃশ্য ঢাকা মেডিক্যালসহ ঢাকার প্রায় হাসপাতালের বিরাজমান। ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা প্রায় সব হাসপাতাল। গত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুতে রেকর্ড করার পর চলতি মাসও রয়েছে নতুন রেকর্ড গড়ার পথে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, যখনই কোনো ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেবে, যেমন তীব্র পেটে ব্যথা, বমি-ডায়রিয়া যে কোনো জায়গা থেকে রক্ত বের হওয়া বা একেবারে দুর্বলবোধ করা সঙ্গে সঙ্গে কাছের কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হবে। বাড়িতে থাকা যাবে না। ভয়াবহতা মোকাবিলায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৫২টি ওয়ার্ডে শিগগির চালু হচ্ছে বিশেষ চিকিত্সা ব্যবস্থা। যেখানে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হবে গুরুতর আক্রান্তদের বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক।

এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে নতুন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৯৮৮ জন। এই সময়ের মধ্যে মারা গেছেন ১১ জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৭৪১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ৯৬৭ জন ঢাকার এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৯৭৭ জন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৯ হাজার ৮১৬ জন রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই ৪ হাজার ২০৭ জন, আর বাকি ৫ হাজার ৬০৯ জন ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে। এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৫১ হাজার ২৭২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং ছাড়া পেয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৭১৫ জন।

ইত্তেফাক/এমএএম