শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নির্বাচনের জন্য স্মার্ট ক্যাম্পেইন

আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২২:৫৭

জি-২০ সম্মেলনে জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সেলফি বা রাহুল আনন্দের বাড়িতে গান-আড্ডায় মেতে উঠা এমানুয়েল মাখোঁ’র ভিডিও সবই এখন চচির্ত বিষয়। মূলত আমাদের প্রতিদিনের রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়গুলো সোশ্যাল মিডিয়াই নির্ধারণ করে দিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া এখন রাজনৈতিক চর্চার মূল প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের ক্ষমতার ৯ বছরেও দেশে কোনো সংবাদ সম্মেলন করেননি। অন্য দেশে গেলেও ভারতের শর্ত থাকে, সাংবাদিকরা মোদিকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। কিন্তু নিজের বার্তাগুলো ঠিকই টুইটারে নিয়মিত টুইট করেন তিনি। সেই টুইট বার্তা-ই সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়ে ওঠে। বিশ্বের সরকার প্রধানদের মধ্যে মোদির সোশ্যাল মিডিয়াতে অনুসারী রয়েছে সর্বাধিক। সোশ্যাল মিডিয়াতে রাষ্ট্রপ্রধানদের জনপ্রিয়তার এই মাপকাঠি বিশ্ব রাজনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ‘দিস ইজ মাই ডিজিটাল লাইফ’ ফেসবুক অ্যাপটির কথা মনে আছে? ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সব জরিপ মিথ্যা প্রমাণ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো এই অ্যাপটি। তখন থেকেই রাজনীতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার ‘স্মার্ট ক্যাম্পেইন’ শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার শুরু করে।

বর্তমানে ডিজিটাল থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া আমাদের দেশের রাজনীতিতেও ‘স্মার্ট ক্যাম্পেইন’ যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদরা ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের প্রচার, বিশেষভাবে তাদের সঙ্গে নতুন ভোটারদের সংযুক্ত, প্রভাবিত এবং সংগঠিত করছেন। আমাদের দেশে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরা, সভা-সমাবেশ, মিছিল বা মাইকে প্রচারণা—ছিল চিরাচরিত নির্বাচনী প্রচার কৌশল। কিন্তু এখন অনলাইনের কল্যাণে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে নির্বাচনী প্রচারে।  বর্তমানে মাঠে অনেকেরই সক্রিয় উপস্থিতি না থাকলেও, প্রায় সবাই কিন্তু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে সরব। যেমন, দেশের বাইরে থাকলেও প্রায় নিয়মিত ফেসবুকে নিজের মতামত প্রকাশ করতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে। অনুসারীর সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে তিনি। তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে অনুসারীর সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি।

ড. আশিকুর রহমান জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সাথে যুক্ত হচ্ছেন

আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান শান্ত। তিনি ১ মে থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা চার মাস নির্বাচনী প্রচারের উদ্দেশ্যে ভোলা-২ দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ি চষে বেড়িয়েছেন। পরবর্তীতে ঢাকায় ফিরেও তিনি নেতা কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে পৌরসভাসহ ইউনিয়নগুলোতে অনলাইনে সাংগঠনিক জুমমিটিং শুরু করেন। 

এ বিষয়ে ড. আশিকুর রহমান বলেন, নির্বাচনী এলাকার ২০টি অঞ্চলে ২০ ‘জুম টিম’ তৈরি করেছি, এতে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে এবং বেশ আগ্রহ উদ্দীপনা নিয়ে অনলাইনের এই জুম মিটিং এ অংশগ্রহণ করে তারা আমার কথা শুনছেন। বড় পর্দার ব্যবস্থা না থাকলেও কর্মীদের ব্যবস্থা করা বড় টিভি বা মনিটরের সামনে মানুষজন দলবেঁধে উপস্থিত হচ্ছেন। বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। তবে তিনি প্রথাগত নির্বাচনী প্রচারের বিকল্প হিসেবে অনলাইনের এই প্রচারকে মানতে চান না।   

‘রুমিন’স ভয়েস’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে রুমিন ফারহানা তার মতামত প্রকাশ করেন

‘বর্তমানে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি ‘ডিজিটাল জনগণ’ তৈরি হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যাদের কাছে মুহূর্তেই পৌঁছে যাওয়া সম্ভব’, রাজনৈতিক সভা সেমিনারে লোক সমাগম ঘটানো অনেক ক্ষেত্রে কঠিন ও ব্যয়বহুল, মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার এই চিরাচরিত রাজনীতির প্রচার কৌশলের বিকল্প হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া খুবই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে।’ এমনটাই বলছিলেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুমিন ফারহানা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয় এই রাজনীতিবিদ নারী হিসেবে বেশির ভাগ সময়ই নানান সাইবার বুলিং এর শিকার হন। 

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি নারী বিদ্বেষী সমাজে বসবাস করি, একজন নারী গলা চড়িয়ে কথা বলবে তা অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। তাই নানা প্রোপাগান্ডার শিকার হতে হয় বেশি। যেমন, আমি একটি বাইকে বসে আছি এমন একটি ছবি আজকে একজন আমাকে পাঠালেন অথচ আমি জীবনে কখনোই বাইকেই উঠি নাই। এমন এডিট করা ছবি ভিডিও দিয়েই মূলত নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। যদিও এতে আমি খুব বেশি মাথা ঘামাই না। 

তিনি আরও বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক রাজনীতিতে এই মিথ্যা গুজব মোকাবিলা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। কেননা বয়স্ক ভোটার যারা রয়েছেন তারা মিথ্যাটা যাচাই করতে পারে না।’  রুমিন ফারহানার ‘রুমিন’স ভয়েস’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। যেখানে তিনি নিয়মিত সরকারের নানা ত্রুটি বিচ্যুতির কথা তুলে ধরেন, দেশের মানুষের স্বার্থে কথা বলেন।

বিভিন্ন সভা সেমিনারে নির্ভিক ঝাঁঝালো বক্তব্যে মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন তরুণদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেন
সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল জনপ্রিয় ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন)। হরহামেশাই সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বক্তব্য ভাইরাল হয়। বিভিন্ন সভা সেমিনারে তার নির্ভিক ঝাঁঝালো বক্তব্য তরুণদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। তার কথায় তরুণরা প্রাণশক্তি পান যেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উপজেলায় স্থানীয় তরুণরা এখন অনেক স্মার্ট তারাই মূলত আমার বক্তব্যগুলো ভিডিও কনটেন্ট হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করে। এই তরুণরাই দেশ বিদেশে আমার বার্তাগুলো পৌঁছে দিতে সহায়তা করে।’ ৭ সেপ্টেম্বর ‘ক্লিক ইত্তেফাকে’ আপলোড করা ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভিডিও তার ভ্যারিফাইড ফেসবুক পেইজ থেকে শেয়ার করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, উন্নয়নের সংবাদ সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করে থাকেন। দেশ বা বিদেশ থেকে তার অনুসারীরা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে তার নামে অজস্র অ্যাকাউন্ট খুলে রেখেছেন। সেখান থেকে তার বক্তৃতার ভিডিওগুলো ভাইরাল হচ্ছে। আগামী নির্বাচনী প্রচারণায় সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিশালী প্রভাব থাকবে বলে মনে করেন নিক্সন চৌধুরী।     

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক মো. আসাদুজ্জামানের ‘বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার: রাজনৈতিক যোগাযোগের ডিজিটাল মোড়’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, রাজনীতিবিদদের পোস্টগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি হচ্ছে রাজনৈতিক পোস্ট। প্রায় ৯ শতাংশ পোস্টের বিষয়বস্তু রাজনীতি-বহির্ভূত। প্রায় ৫৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ রাজনৈতিক পোস্টে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতা (যেমন নিজের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার খবর) ছিল। অন্যদিকে রাজনীতিবিদেরা অন্য কোনো রাজনীতিবিদের পোস্ট শেয়ার করেছেন ৩৩.৯৭ শতাংশ।

জনসংযোগ খাতে রাজনৈতিক যোগাযোগের এ নয়া-মাধ্যম এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। তাই অনেক রাজনীতিবিদ তাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো পরিচালনার জন্য স্মার্ট পিআর (পাবলিক রিলেশনস) কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে থাকেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবস্থাপক বলেন, তিনি চার বছর ধরে একজন প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রীর ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট দেখাশোনা করছেন। তিনি জানান, একজন রাজনীতিবিদের জন্য প্রতিটি পোস্টই অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই তারা এমন কাউকে এ কাজে নিয়োগ করেন যাদের বিশ্বাস করেন। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে রাজনৈতিক কর্মসূচির তোড়জোড় ততো বাড়বে তখন এই পিআর কর্মকর্তাদের চাহিদাও বাড়বে।

তাই এটা ধরে নেওয়া যায়, সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্মার্ট ক্যাম্পেইন বাংলাদেশে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অন্যতম প্রভাবক হিসাবে কাজ করবে।

ইত্তেফাক/পিও

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন