বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাতে সচেষ্ট হলেই সম্ভব ওজোন স্তর ক্ষয় প্রতিরোধ করা। এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরো মনে করেন, নগরায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা উচিত। ইত্তেফাক অনলাইনের সঙ্গে আলোচনায় তারা একথা বলেন।
ওজোন স্তর ক্ষয় বৈশ্বিক সমস্যা বলেই মানুষের সচেতনতার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
'মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়ন করি-ওজোন স্তর রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করি’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারো সারাবিশ্বে পালন করা হচ্ছে ওজোন দিবস। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ দিবস পালন হয়ে আসছে। ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোনস্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়। এই দিনটিতেই পালন হয় বিশ্ব ওজোন দিবস বা আন্তর্জাতিক ওজোন রক্ষা দিবস হিসেবে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এই মন্ট্রিল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে। এরপর থেকে বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয়।
ওজোন স্তরে ক্ষয় পরিবেশবিজ্ঞানীদের বহুদিন উদ্বেগে ভুগিয়েছে। মানবজাতি ধ্বংসের মুখে অসহনীয় যন্ত্রণার শিকার হতে পারে এ ভেবে বহুদিন ওজোন স্তরকে কীভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে গবেষণা চলেছে। একুশ শতকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ওজোন স্তরের ক্ষয়রোধের বিষয়ে একত্রিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। জাতিসংঘ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম শুরু করে এবং চলতি বছর জানুয়ারিতে জাতিসংঘের এই প্রোগ্রাম সুখবর দিয়েছে। তারা জানিয়েছে ওজোন স্তর রক্ষা করার পরিবেশগত প্রক্রিয়া সফল হচ্ছে। ওজোন স্তর আস্তে আস্তে তার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাচ্ছে। জাতিসংঘের প্রত্যাশা এই প্রক্রিয়া পুরোপুরি সফল হলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো সম্ভব হবে।
বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজকর্মী আফতাব আহমেদ বলেন, ‘জাতিসংঘ ইতোমধ্যে ওজোন স্তর রক্ষার জন্য প্রযুক্তিগত পরিকল্পনার পাশাপাশি ধারাবাহিক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে গ্রিন হাউজ গ্যাস কমানোর জন্য গাছ লাগাতে হবে। গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ কমছে। তাই গাছ লাগানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। ইতোমধ্যে দাবদাহ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা জমা হলে কি ভয়ংকর পরিস্থিতি হতে পারে। কারণ এই তাপমাত্রা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে বের হয় না। তাই গাছ লাগাতে হবে।’
ওজোনস্তরের রক্ষার বিষয়ে নগরাঞ্চলের পরিকল্পনা বিষয়ে আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ‘নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা প্রায়শই কৃত্রিম ডেকোরেশনের কথা বলে থাকি। কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে নগর সাজানোর কথা ভাবা হয় না। ফুটপাথে লাগানোর উপযোগী গাছ লাগাতে হবে। পথের ডিভাইডারে প্রতিবন্ধক না দিয়ে বড় এবং সুন্দর গাছ লাগানো যেতে পারে। আধুনিক গ্রিন প্রযুক্তির ব্যবহার করা কঠিন না।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশভিত্তিক সংগঠন ইয়েস বাংলাদেশ-এর সদস্য সাকিব বলেন, ‘আসলে বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমরা কাজ করি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ থাকে। মূলত পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে আমাদের ক্যাম্পেইন থাকে। বিশেষত ওজোন স্তর রক্ষা দিবসে আমরা নতুন শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা কর্মশালা করে থাকি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ওজোন স্তর রক্ষার বিষয়টি কোনো রাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্ভব না। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে একটি রাষ্ট্র নিজে যদি ওজোন স্তরের ক্ষয়িষ্ণুতার নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচতে চায় তাহলে কিছু কর্মসূচি নিতে পারে। সেক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণ কমানোই প্রধান কাজ। শুধু গাছ লাগালেই হবে না। আমাদের তেল, গ্যাস বা যেসব জীবাশ্ম জ্বালানি বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে সেগুলো কমাতে হবে। শিল্প কারখানাকে পরিবেশ সংবেদনশীল কাঠামো গড়ে নিতে হবে। উন্নত বিশ্বে যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা ভবন করার আগে কার্বন ফুটপ্রিন্ট করা হয়। আমাদের এখানে বিল্ডিং কোড থাকলেও কার্বন ফুটপ্রিন্টের বিষয়টি এখনও আসেনি।’
ড. জিল্লুর রহমান আরও বলেন, ‘গ্রিন টেকনোলজি ব্যয়বহুল হলেও আমাদের দেশে এর ব্যবহার চালু করা যেতে পারে। এখন প্রচুর ব্যয় হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল আমরা পাবো। আর আমরা যখন বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা জমাট বাঁধা কমাতে পারব তখন সারা বিশ্বই আমাদের মডেল হিসেবে গ্রহণ করবে।’
পরিবেশকর্মী শাহরিয়ার সাজ্জাদ হোসেন বলেন,‘জাতিসংঘ জানিয়েছে তাদের প্রযুক্তিগত কর্মসূচি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে ২০৪০ সাল নাগাদ ওজোন স্তরের গর্ত বা কম পুরুত্ব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। কিন্তু কার্বন বা সিএফসি নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হবে। আমাদের দেশে অনেক স্থানে ইটভাটা, শিল্পকারখানা, কাঁচ বা প্লাস্টিক উৎপাদনের কারখানা, লোহা-রড ও ইস্পাতের কারখানা প্রচুর কার্বন নিঃসরণ করে। এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমাদের নানা সমস্যা দেখা দেয়। তাই আমাদের এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে যাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় করা যায়। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে আজকাল বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। আবার নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমেই যানবাহনে আমরা চার্জ দিতে পারি। এসবকিছুই আমাদের দেশে রয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন মানুষকে বোঝানো। অনেকে ইলেকট্রিক বাইক কিনতে চান না। বা কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেয় না শিল্পপ্রতিষ্ঠান। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি। একইসঙ্গে জরুরি মানুষের মধ্যে সচেতনতা। ব্যক্তি পর্যায়ে গাছ লাগানো, এমন পণ্য ব্যবহার যাতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়। পরিবেশ সংবেদনশীলতা জরুরি।’
ওজোন স্তরের বর্তমান অবস্থা কী?
ওজোন স্তরে গর্ত নিয়েই বিগত দুই দশক সকলে চিন্তিত ছিল। চলতি বছর ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সি ওজোন স্তরের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ১৯৭৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দক্ষিণ মেরুতে ওজোন স্তরের ক্ষয়ের একটি চিত্র দেখিয়েছে। দেখা যাচ্ছে ২০১৯ এ ওজোন স্তরে ক্ষয়ের পরিমাণ কমে গেলেও ২০২০ সাল থেকে তা বড় হতে শুরু করে। ২০২২ সালেই সবচেয়ে বড় গর্তটি শনাক্ত করা গেছে।