শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নানা প্রতিবন্ধকতায় থমকে আছেন নারী উদ্যোক্তারা

অনেকে সুযোগ-সুবিধা পান না, কেউ-বা কাজে লাগাতে পারেন না

আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:৩০

করোনাকালে ঘরে বসে অনেক নারীই নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ যেমন সংসারে প্রভাব ফেলেছে, তেমন নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করেছেন তারা। কিন্তু পরে অনেকেই আর উদ্যোক্তা পরিচয় ধরে রাখতে পারেননি। একটা বড় স্বপ্ন দেখেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে থমকে গেছে অনেকের যাত্রা। নারীর ক্ষমতায়নে সরকার যেমন সহযোগিতা করছে, তেমন অনেক ক্ষেত্রে অসহযোগিতারও অভিযোগ আছে। আবার অনেকে সুযোগ পেয়েও সেটি কাজে লাগাতে পারছেন না। 

শুধু মাত্র রপ্তানির জন্য পাট ও হস্তশিল্প পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তরঙ্গের কর্ণধার কোহিনূর আকতার মনে করেন, ১৯৯৪ সালে তিনি যখন শুরু করেন তখন এমনভাবে নারীদের কাজের সুযোগ ছিল না। সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এসএমই ফাউন্ডেশন নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণসহ ঋণসুবিধা দেয়। অনেক নারী এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কাজে টিকে থাকতে পারে না। এর পেছনের কারণ হিসেবে একাগ্রতা ও অধ্যবসায়ের অভাব, ঠিকভাবে কাজ না শেখা, নিজের মেধাকে কাজে না লাগাল, অনলাইনে অন্যের পণ্য কপি করা ইত্যাদির কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিস্থিতির কারণে বিশ্বে আমাদের সোনালি আঁশ পাটের অনেক চাহিদা আছে। যথাযথভাবে শিখে কাজ শুরু করলে মেয়েরা ভালো কিছু অর্জন করতে পারবে।

একই কথা বলেন চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িত তানিয়া ওহাব। এই উদ্যোক্তা মনে করেন, আমাদের চামড়ার বাজার ধরার বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে আগ্রহ নেই। দেশে অনেক ফ্যাশন শো হলেও জুতা বা ব্যাগ নিয়ে কোনো শো হয় না। চামড়া শিল্পর জন্য সেভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। অথচ আমাদের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা আছে বিশ্ব বাজারে। এসব বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীর ঋণ গ্রহণ ব্যবস্থা সহজকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ অনুযায়ী, দেশের ৭৮ লাখের বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক ২ ভাগ নারী উদ্যোক্তা। বিবিএস ‘হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে-২০২০ মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিলো ২ লাখেরও বেশি, যা ২০০২-০৩ অর্থ বছরে ছিল মাত্র ২১ হাজার।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচন এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০৭ সালে ‘এসএমই ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করে সরকার। শুরুতে তারা ৬০০ জন নারী উদ্যোক্তাকে সহায়তা করে বলে জানান এসএমই ফাউন্ডেশনের জেনারেল ম্যনেজার ফারজানা খান। 

তিনি বলেন, ৬০০ থেকে বর্তমানে ১৫০টি পরিকল্পনার মাধ্যমে ৩০ হাজারে উন্নীত হয়েছে নারী উদ্যোক্তা। ফারহানা আরও জানান, বর্তমানে নারী উদ্যোক্তাগণ বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, চামড়াজাত পণ্য, পর্যটন, ফ্যাশন ও সৌর্ন্দয পণ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন ব্যবসায় পাশাপাশি গার্মেন্টস ও অ্যাকসেসরিজ, রিটেইল শপ, সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য ও হস্তশিল্প খাতে ব্যবসার উদ্যোগ বেশি। তিনি বলেন, তার পরও আমাদের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের পুরুষের তালে তাল রেখে এগিয়ে যেতে বাধা দেয়। তবে পরিবার অনেক এখন সহযোগিতা পরায়ণ বলে মনে করেন তিনি।

উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম-উই প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, করোনা কালে সাড়ে ৪ লাখ নারী ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত হয়। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ঝরে পরে। কাঁচা মালের দাম বেশি, পাইকরা নিজেরাই অনলাইন ব্যবসা শুরু করা, এক জায়গায় নিজেকে আটকে রাখা—এমন হয় কারণ নারীর পথে প্রতিবন্ধকতা বলে উল্লেখ করেন তিনি। 

ঢাকা উইমেন্স চেম্বার অ্যান্ড কমার্স ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট নাজ ফারহানা আহমেদ বলেন, ব্যবসার জন্য এখনো পুরো নারীবান্ধব পরিবেশ হয়ে ওঠেনি। তাই বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে না। অনলাইনে নারী উদ্যোক্তাকে ধরে রাখতে যেমন প্রযুক্তি শিক্ষা দিতে হবে, তেমন নারীর জন্য ঋণ সুবিধা সহজ, আধুনিক প্রশিক্ষণ আর নারীদের এগিয়ে আসার প্রত্যয় থাকতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের জটিলতায় দীর্ঘ দিন ভুগছে নারী উদ্যোক্তারা। এর পরিবর্তন জরুরি।

ইত্তেফাক/এমএএম