সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

তিতাসের এমডির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু পেট্রোবাংলার

মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে ঘুষের বিনিময়ে গ্যাস-সংযোগের অভিযোগ

আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:০০

সরকারের নির্দেশনা অমান্য, কোম্পানির সিস্টেম লস বাড়ানো এবং ঘুষের বিনিময়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস-সংযোগ দেওয়াসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বিরুদ্ধে। এমনকি অনিয়ম করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ভাঙানোর অভিযোগও তার বিরুদ্ধে উঠেছে। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে দেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ খাতে।

তিতাস গ্যাসের এমডি মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহর বিরুদ্ধে আনা অনিয়মের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে গত রবিবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। সংস্থাটির পরিচালক (প্রশাসন) মো. আলতাফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিকে ২০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এর আগে গত ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে গ্যাস-সংযোগ প্রদানসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বিষয়টি তদন্ত করে মতামতসহ প্রতিবেদন দিতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ গত ১২ সেপ্টেম্বরে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দেয়। এ জন্য এক মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সে সময়সীমা শেষ হবে।

মূলত প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বরাবর আব্দুল লতিফ নামে একজনের চিঠির সূত্র ধরে অনিয়মের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, গত এক সপ্তাহে মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাসের প্রধান কার্যালয় ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে অনিয়মগুলো নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলাপ হয়েছে। আলাপে ও প্রাথমিক খোঁজখবরে কয়েকটি অনিয়মের অভিযোগ সত্য বলে মনে হয়েছে। তবে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত এবং নথি যাচাই না করা পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। তাই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

চিঠির সূত্র ধরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাজীপুরের পিরুজালী এলাকায় অবস্থিত সিলভার নিট কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের কারখানায় বয়লার ও গ্যাসচালিত জেনারেটরের জন্য নতুন গ্যাস সংযোগের আবেদন করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গ্যাস সংযোগের জন্য ঐ আবেদনপত্রটি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বরাবর লেখা হলেও সেখানে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো সিল, স্বাক্ষর কিংবা নির্দেশনা নেই। কিন্তু ঐ আবেদনের ওপর নির্দেশনা দিয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ লিখেছেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস হতে প্রেরিত। আলাপ করবেন।’ এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তার দপ্তর থেকে এ ধরনের চিঠি কিংবা নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। অথচ তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবেদনপত্রে মন্ত্রীর (প্রধানমন্ত্রীর) অফিসের কথা উল্লেখ করেছেন। তিতাস এমডির নির্দেশনা-সংবলিত আবেদনপত্রটি তিতাসের গাজীপুরের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসানকে পাঠানো হয়। আর ঐ প্রতিষ্ঠান গ্যাস সংযোগও পেয়ে যায়। অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে তিতাস গ্যাসের এমডি হারুনুর রশীদ মোল্লাহর সঙ্গে কয়েক দফায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি নজরে আসার পর গত ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক রূপালী মণ্ডল স্বাক্ষরিত একটি চিঠি জ্বালানি বিভাগের সচিবকে পাঠানো হয়। ঐ চিঠিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর (প্রধানমন্ত্রী) নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণ করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ প্রদানসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে পরীক্ষা করে বিধি মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব বরাবর পাঠানো এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) কিংবা প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও উৎকোচ গ্রহণ করে সিলভার নিট কম্পোজিটের আবেদন অনুমোদন করা হয়। সেটির সঙ্গে এসএম এক্সেসরিজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ছয় মাসের পুরোনো আবেদনও অনুমোদন করিয়ে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়।

লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিতাসের সিস্টেম লস ছিল ৫ থেকে ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বকেয়া বিল আদায়েও পক্ষপাত রয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিতাসের এমডি অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। ঘুষের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিমানা মওকুফ, বিল বকেয়া থাকা সত্ত্বেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করা, সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার করাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত তিনি।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান হারুনুর রশিদ মোল্লাহ। পরে দ্বিতীয় দফায় আরও এক বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। সম্প্রতি আবারও তার নিয়োগের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে।

ইত্তেফাক/এমএএম