ডেঙ্গুর ভয়াবহ রূপ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার বাইরে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগী। মৃত্যুর মিছিলে রূপ নিচ্ছে। চিকিৎসার ব্যয়ভারও বেড়ে যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩০৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৯৪ জন আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১৯০ জন। এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ৭ জন ঢাকার। ঢাকায় মৃত্যু বেশি হওয়ার কারণ সারাদেশ থেকে রোগীরা ঢাকামুখী হচ্ছেন।
তামাশা না করে মশা মারার তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মশা মারার জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কেউই তা শুনছে না। চোর না শোনে ধর্মের কাহিনীর মতো অবস্থা হয়েছে। মশা মারার কার্যকর কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এখনই ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো রোগী সামাল দিতে পারছে না। মশা না মারলে অদূর ভবিষ্যতে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে অনেক রোগী মারা যাবে। এখনই মিলছে না আইসিইউ। মশা না মারলে ভবিষ্যতে সারাদেশ আইসিইউ বানিয়েও সামাল দেওয়া যাবে না। মৃত্যুর মিছিলে পরিণত হবে দেশ। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৭৪ হাজার ১২৭ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯৬ হাজার ৬৪১ জন।
এদিকে ডেঙ্গু রোগীদের ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাদের অবস্থা খারাপ তারা ঢাকায় আসতে পারে। কিন্তু এখন ডেঙ্গু হলেই ঢাকায় আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে আসা-যাওয়ার বিলম্বে অনেক রোগী রাস্তায় মারা যায়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম রোগীদের সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আসা হয়। ওই অ্যাম্বুলেন্সে থাকে না আইসিইউ। অথচ শক সিনড্রোমের রোগীদের আইসিইউ সাপোর্টে রাখতে হবে। এসব অব্যবস্থাপনা যেন দেখার কেউ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধুমাত্র নির্দেশনা দেয়, সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটা তারা মনিটরিং করে না। অধিদপ্তরের অধিকাংশ নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ের কেউ মানেন না। অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জনরাও যথাযথ মনিটরিং করেন না। দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিকাংশ কর্মকর্তাই কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে তারা নিয়মিত মাসোহারাও পেয়ে থাকেন। এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা প্রোটোকল পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান যে গাইডলাইন সেটা উপযুক্ত নয় বলেই রোগী বেশি মারা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা সেবা গাইডলাইন তৈরি করে সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলেন, এতে রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। যে যেখানে আছে সেখানেই চিকিৎসা সেবা নিলেই হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মশা মারতে গেলে অভিজ্ঞ জনবল লাগে। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশা মারলে কোন কাজে আসবে না। মশা না মারার খামখেয়ালিপনার জন্য এই যে মৃত্যু বাড়ছে, একদিন ওই সব দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিচারের কাঠগড়ার উঠতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যু যে হারে বাড়ছে, তাতে দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার প্রোটোকল পরিবর্তন করা দরকার। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে চিকিৎসা সেবার নতুন গাইডলাইন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নতুন গাইডলাইন দিয়ে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে ঢাকার বাইরের রোগীদের ঢাকায় আনার প্রয়োজন হবে না। তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে থেকে অনেক শক সিনড্রোম রোগীদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে পাঠানো ঠিক হচ্ছে না। শক সিনড্রোম হওয়ার আগেই রোগীদের পাঠানো উচিত। কারণ শক সিনড্রোম রোগীদের আইসিইউয়ের প্রয়োজন হয়। তিনি বলেন, মশা মারার কোন বিকল্প নেই। নইলে মৃত্যু বাড়তেই থাকবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিলের দিকে যাচ্ছে দেশ। তারপরও মশা মরার কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। প্রতিদিন রোগী বাড়ছে। হাসপাতালে জায়গা নেই। চিকিৎসা সেবার জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে করতেই অনেকে মারা যাচ্ছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত মশা না মেরে শুধু বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের মানুষ বিরক্ত। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশা মারার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশা মারা জনগণের সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, মশা কামড়ালে এই রোগ হবে-এটাই স্বাভাবিক। মশা নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডেঙ্গু রোগী নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। বর্তমানে এক বেডে তিন জন রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সামাল দেওয়া হচ্ছে। মশা মারার দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের নয়। দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি না বোঝেন, মশা না মারেন তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।