অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। ডেঙ্গুর রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। ভয়াবহতার চিত্রটি বোঝা যায় হাসপাতালে গেলে। রাজধানীর প্রতিটি হাসপাতালে এখন ডেঙ্গু রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। এক বেডে দুইয়ের অধিক ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। মেঝেতেও জায়গা নেই। হাসপাতালের মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা।
এদিকে কোনো কোনো হাসপাতালে চিকিৎসকদের চেম্বারে পর্যন্ত এক্সট্রা বিছানা দিয়ে রোগী রাখা হয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও রোগী রাখতে হচ্ছে হাসপাতালের বারান্দাতেও। রোগীর স্যালাইন বেঁধে রাখা হচ্ছে জানালার গ্রিলে কিংবা কলাপসিবল গেইটে। এই ভয়াবহতার মধ্যে রোগীরা কেবল চিকিত্সকের চোখের সামনে থাকবেন এজন্য একটু জায়গা চেয়ে যেখানে সুযোগ পাচ্ছেন সেখানেই বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর উদ্বেগ নিয়ে শয্যা পাশে বসে আছেন স্বজনরা। ডেঙ্গু রোগীর চাপে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। অস্ত্রোপচার প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মশা একটি চিহ্নিত শত্রু। কিন্তু তার পরও কেন মশা মারা হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়। অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার কারণে ইতিমধ্যে মশা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। মরছে না মশা। হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষরা বলেন, কোনো রোগীকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। তবে মশা না মারলে সামনে রোগী আরো বাড়বে। সীমিত জনবল দিয়ে কত ক্ষণ ডেঙ্গু রোগীদের সামাল দেওয়া যাবে তা এখন ভাবার বিষয়।
এদিকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৪৬ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ২৭ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৪৯ জন ও ঢাকার বাইরের ২ হাজার ১৭৮ জন। একই সময়ে মারা যাওয়া সাত জনের মধ্যে চার জন ঢাকার ও তিন জন ঢাকার বাইরের বাসিন্দা।
রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমনিতেই জনবল সংকট। ঢাকায় যেভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে সেগুলোই সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় ডাক্তার-নার্স ও কর্মচারীদের। তার ওপর ঢাকার বাইরে সারা দেশের মানুষ যখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, তখনই ঢাকায় ছুটে আসছেন। অবশ্য ঢাকামুখী হতে গিয়ে অনেকে রাস্তায় মারাও যাচ্ছেন। তবে ঢাকার বাইরের রোগীরা রাজধানীতে আসায় বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে ডাক্তার-নার্সদের উপর। ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে সাত জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। ধারণ ক্ষমতার তিন গুণ রোগীর সেবা দিচ্ছেন ডাক্তার-নার্সরা। হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষরা বলেন, প্রতিদিন এইভাবে বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে কেউ চিকিৎসা পাবে, আবার কেউ পাবে না। চিকিৎসাব্যবস্থা এই পরিস্থিতির দিকে যাবে। চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। তাই সময় থাকতে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়তি চাপ কতক্ষণ ধরে রাখা যাবে সেটা ভাবার সময় এসেছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, প্রতিদিনই প্রচুর ডেঙ্গু রোগী আসছে রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে। কোনো রোগীকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। এক বেডে দুই থেকে তিন জনকে রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। মেঝেতেও জায়গা নেই। এই বাড়তি চাপ কতক্ষণ ধরে রাখা যাবে সেটাই দেখার বিষয়।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, প্রচুর ডেঙ্গু রোগী আসছে। কোনো রোগীকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। তবে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে চিকিৎসক-নার্স ও কর্মচারীরা কতক্ষণ চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যেতে পারবেন সেটা ভাবার বিষয়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর প্রচুর চাপ। ঢাকার বাইরে থেকে বেশি রোগী আসছেন। অনেকে ফোন করে বলছেন, রোগী নিয়ে আসতেছি, দয়া করে একটি বেড দিয়েন। কিন্তু কোনো বেড এখন খালি নেই। একই অবস্থা বিরাজ করছে মিটফোর্ট হাসপাতালসহ রাজধানীর সবগুলো সরকারি হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, এই পরিস্থিতিতে ডাক্তাররা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে তারা কতক্ষণ চালিয়ে যেতে পারবেন সেটা ভাবার বিষয়। মশা মারলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু সেই মশা মারা হচ্ছে না। এ কারণে দিন দিন রোগী দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না বলে চিকিৎসকরা জানান।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, মশা মারতে হবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। কিন্তু দেশে অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় মশা মারা হচ্ছে। এ কারণে মশা এখন প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা আমাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। তাই সময় থাকতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশাকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা খামখেয়ালিপনা করছে তা বোধগম্য নয়। ডেঙ্গু অনেক দেশেই হয়েছে। সেসব দেশ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। এখনই মশা নিধনের কার্যক্রম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা না হলে সামনে আরও ভয়াবহ বিপদ।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সোমবার রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী দীপান্বিতা বিশ্বাস (২৫) মারা গেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর আগে ডেঙ্গুতে মারা যান ডা. বায়োজিদ আহমেদ (৩০), ডা. শরিফা বিনতে আজিজ, ডা. আল মিনা দেওয়ান মিশু, ডা. এম এ আরিফুর রহমান, ডা. সৈয়দা সাদিয়া ইয়াসমিন রাইচা ও ডা. ফাতেমাতুজ জোহরা। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৫ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৪ হাজার ৯৭৬ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ৯৮ হাজার ৮১৯ জন ভর্তি হয়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৮৪৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫৭৮ জন এবং ঢাকার বাইরের ২৬৮ জন।