রোববার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

মিরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু এবং দায় এড়ানোর চেষ্টা

আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২২:৫১

বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া রাজধানীর রাস্তায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মৃত্যু হয়। মিরপুরে কমার্স কলেজ সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

যারা মারা গেছেন তারা হলেন মিজানুর রহমান (৩০), তার স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫), তাদের মেয়ে লিমা (৭) এবং অটো রিকশা চালক মোহাম্মদ অনিক (২০)। অনিক মিজানুরের পরিবারকে বাঁচাতে গিয়ে মারা যান। মিজানুরের ছয় মাস বয়সি শিশুপুত্র হোসাইনকে আহত অবস্থায় শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া আরো পাঁচ-ছয়জন আহত হয়েছেন বলে স্থানীরা জানান। তারা সবাই মিরপুর কমার্স কলেজের পিছনে ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দা।

মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মো. মোহসীন বলেন, ‘বস্তি সংলগ্ন সড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়। ওই পানিতে বিদ্যুতের তার ছিড়ে পড়ে পানি বিদ্যুতায়িত হয়। তাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওই চারজন মারা যান।’

তবে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডেসকোর পরিচালক মো. কাওসার আমির আলীর দাবি, তারা প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছেন, মূল বিদ্যুৎ লাইন ছিঁড়ে পড়েনি বা সেখান থেকে পানি বিদ্যুতায়িত হয়নি। তিনি মনে করেন, বস্তির কোনো লাইন থেকে এটা হতে পারে।

মৃতদের প্রতিবেশী বৃষ্টি রায় বলেন, ‘বস্তির বিদ্যুতের লাইন মাটির নীচ থেকেও আছে, আবার উপর থেকেও আছে। এখানে অনেক অবৈধ বিদ্যুৎ লাইনও আছে। তার কোনো লাইন থেকেই পানি বিদ্যুতায়িত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এখানকার লাইনগুলো অধিকাংশই অরক্ষিত।’

তিনি বলেন, ‘রাত সাড়ে ৯টার দিকের ঘটনা। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে তারা দ্রুতই আসে। আসার পর এলাকার লাইন বন্ধ করে দেয়। তা না হলে আরো লোকের মুত্যু হতে পারতো। তারপরও আরো পাঁচ-ছয় জন আহত হয়েছেন।’

বৃষ্টি একটু কমে এলে ওই পরিবারটি তাদের এক আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল।

বৃষ্টি রায় জানান, বস্তিতে এক হাজারেরও বেশি পরিবার বসবাস করে। তাদের অধিকাংশেরই বৈধ বিদ্যুৎ লাইন নেই। তাদের একটি চক্র অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। ফলে লাইনগুলো খুবই অরক্ষিত এবং হুক দিয়ে করা হয় যাতে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এলে তারা দ্রুত নিজেরাই সংযোগ সরিয়ে ফেলতে পারে।

ডেসকোর পরিচালক মো. কাওসার আমির আলী বলেন, ‘আমরা বস্তিতে ১০ টি ঘরের জন্য একটি লাইন ও মিটার দিই। ওই ১০ টি পরিবার একসঙ্গে লাইনটি ব্যবহার করে। আমাদের দায়িত্ব সংযোগ দেয়া মিটার পর্যন্ত। ভিতরের বিষয় আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। স্থাপনার কারণেই তাদের লাইন দুর্বল থাকে। আমরা ধারণা করছি, ওই লাইন ছিঁড়ে বা লিক হয়ে পানি বিদ্যুতায়িত হয়েছে।’

তার কথা, ‘আবাসস্থল সুরক্ষিত না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু বস্তি ঠিক করার দায়িত্ব তো আমাদের নয়। আবার বস্তিতে বিদ্যুৎ না দিলেও আমরা সমালোচনার মুখে পড়ি। আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত শেষে বলা যাবে কিভাবে পানি বিদ্যুতায়িত হলো। তবে আমাদের মূল লাইন থেকে যে হয়নি সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। আমরা আমাদের লাইন, ট্রান্সমিটার সব পরীক্ষা করে দেখেছি। সেখানো কোনো সমস্যা হয়নি।

বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায়ই অভিযান চালাই। বিচ্ছিন্ন করি। কিন্তু তারা আবার সংযোগ দেয়। এত বড় বস্তি তো ২৪ ঘণ্টা আমাদের পক্ষে দেখে রাখা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘এই ধরনের দুর্যোগের শিকার প্রধানত নিম্নবিত্ত বা গরিব মানুষই হন। কারণ, তাদের আবাস্থল পরিকল্পিত এবং নিরাপদ নয়। বস্তিতে বিদ্যুৎ বা গ্যাস লাইন যা-ই বলুন না কেন, সবই অপরিকল্পিত এবং অরক্ষিত। আর এর মূল্য তাদের জীবন দিয়ে দিতে হয়।’

তার কথা, ‘বস্তির অবকাঠামো যদি বিদ্যুৎ সংযোগের উপযোগী না হয়, তাহলে তো তারা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই সেখানে বসবাস করেন, বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। আর অবৈধ সংযোগের পিছনে তো বিদ্যুতের লোক আছে। এখানে তো অনেক অর্থের লেনদেন হয়।’

‘এই মৃত্যুর দায় তাই যেমন বিদ্যুৎ বিভাগ এড়াতে পারে না, তেমনি সরকারের গৃহায়ন কতৃপক্ষ, রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশনও এড়াতে পারে না। আর সর্বোপরি নিরাপদ আবাসনের দায়িত্ব সরকারের,’ বলেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।

(জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের)

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন