রোববার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আজ বিশ্ব নদী দিবস

জৌলুস হারাচ্ছে শীতলক্ষ্যা

আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৩০

আজ ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবস। নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার পালিত হয় দিনটি। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল বিসি রিভারস ডে পালন দিয়ে। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে আসছে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে। এবারের বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আমাদের জনবীবনে নৌপথ’। এই দিবসে কালীগঞ্জের শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী নিয়ে এই আয়োজন।

একটা সময় শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী ছিল দুই পাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস। এক সময়ে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর পানি পান করতো মানুষ। এতে মাছ ধরে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় সব কিছুই পাল্টে গেছে। নদীর পানি পান তো দূরের কথা, এখন শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে মাছ পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। ক্রমাগত দূষণের কবলে পড়ে যেমন জৌলুস হারাচ্ছে ১১০ কিলোমিটারব্যাপী প্রশস্ত শীতলক্ষ্যা, তেমনই অর্ধমৃত হয়ে পড়েছে ৪৪ কিলোমিটারব্যাপী প্রশস্ত বালু নদীটিও। নদী পাড়ের বাসিন্দারা একসময় রান্নাবান্নাসহ ঘরের কাজে এই দুই নদীর পানিই ব্যবহার করতেন।

ছবি: ইত্তেফাক

জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা নদী পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপন্ন। এটি নারায়ণগঞ্জ হয়ে গাজীপুরের কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলা অতিক্রম করেছে। গাজীপুর জেলার টোক নামক স্থানে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে একটি ধারা বানার নামে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে লাখপুর নামক স্থানে শীতলক্ষ্যা নাম ধারণ করে বৃহত্তর ঢাকা জেলার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা কলাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীতে পড়েছে। নদীটি নাব্য এবং সারা বছরই নৌ চলাচলের উপযোগী। শীতলক্ষ্যার ভাঙন প্রবণতা কম। অন্যদিকে, বালু নদী বেলাই বিল ও ঢাকার পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জলাভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডেমরার কাছে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে পড়েছে। শীতলক্ষ্যার সঙ্গে কাপাসিয়ার কাছে সুতি নদীর মাধ্যমেও এর একটা ক্ষীণ যোগাযোগ আছে। একই ধরনের সংযোগ রয়েছে টঙ্গী খালের মাধ্যমে তুরাগ নদীর সঙ্গে। কালীগঞ্জের কাছেও বালু নদী শীতলক্ষ্যার সঙ্গে মিশেছে। বন্যার মৌসুমে বালু নদী শীতলক্ষ্যা ও তুরাগের পানি বহন করে। এই নদীর প্রধান গুরুত্ব হচ্ছে স্থানীয় জল নিষ্ক্রমণ ও নৌ-পরিবহন অব্যাহত রাখা।

নদী সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশের নদনদীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তালিকায় থাকা মোট ৩৮৩টি নদীর অনেকগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। দূষণ ও ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের পাশাপাশি অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন, আবাসন এবং সেতু, কালভার্ট ও স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে ছোটবড় আরও অনেক নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। নদনদী ও প্রাকৃতিক খাল রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করেছে। তবে প্রয়োজনীয় জনবল ও অন্যান্য সুবিধা না থাকায় সংস্থাটি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।

নদী পাড় এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ইত্তেফাকের এই সংবাদদাতা জানতে পেরেছেন যে, ছোটবেলায় তারা শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে গোসল করেছেন, সাঁতার কেটেছেন। এই নদীর পানি খেয়ে বড় হয়েছেন। কিন্তু এখন নদীর পানি এত নোংরা ও দুর্গন্ধ যে, স্পর্শ করা দূরের কথা, নাম নিতেও কষ্ট হয়।

ছবি: ইত্তেফাক

কালীগঞ্জে নদী নিয়ে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল। কথা হয় সংগঠনটির কয়েকজন নদী কর্মীর সাথে। তারা বলেন, আমাদের নদীগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকার লাগায়ো কালীগঞ্জে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী আজ দখলে দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ক্ষমতার প্রভাবে ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান নদী দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কিন্তু এই নদীগুলো তো আমাদের জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমাদেরকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। শুধু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নয়, নদীর হয়ে কথা বলতে হবে সর্বস্তরের শ্রেণি-পেশার মানুষকে। তাহলেই নদী ভালো থাকবে। নদী ভালো থাকলেই, ভালো থাকবো আমরা ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের নগরায়ণের ফলে নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে তার ফলাফল শূন্যই থেকে যায়। আমরা ধীরে ধীরে নদী দূষণ করছি ও দখল করছি। এখন যদি এসব বন্ধ করতে না পারি, তবে সামনে আমাদের দুর্দিন ধেয়ে আসছে।

ছবি: ইত্তেফাক

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীকে বাঁচাতে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্নভাবে সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছি। অথচ প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে আজো শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর দখল ও দূষণ বন্ধ করা যায়নি।’

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘সরকারি স্বার্থ বিনষ্ট করবে যত বড়ই শক্তিশালী হোক তা আমি করতে দেবো না। নদী দখল ও দূষণে যারা জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দেবো না।’

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এরই মধ্যে জেলার শ্রীপুর উপজেলার লবণদহ নদীর দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একইভাবে বিআইডব্লিউটিএ, নদী কমিশন ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ইত্তেফাক/এইচএ